অভীক ঘোষ- বেগমপুর
বাংলার তাঁতের একসময়ে ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু যুগের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বাংলার তাঁত এখন ধ্বংসের মুখে। বাঙালির শ্রেষ্ট উৎসবের আগের তাঁতিদের ব্যস্ততা থাকে তাঁতের শাড়ি তৈরির। আগে চরম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটতো তাঁতিদের। আর মাত্র ১২ দিন বাকি সারদ উৎসবের। কোভিডের পর থেকে খটাখট শব্দে মুখরিত হয় না বাংলার তাঁতঘরগুলি। এখন কখনও কখনও হয়তো তাঁতঘর গুলো থেকে খটাখট শব্দ হয়। বেশিরভাগ তাঁতিই কর্মহীন। বহু তাঁতশিল্পী এখন নিজেদের অন্য পেয়ায় নিযুক্ত করেছেন। শাড়ির দুনিয়ায় রকমারি আসায় হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার তাঁত। রজ্যের হাজার হাজার তাঁতঘর এখন খাঁখাঁ করছে। দিন কয়েক পরেই বাংলার মানুষ মেতে উঠবে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে। কিন্তু উৎসবের আনন্দ একেবারে নেই বাংলার তাঁতিদের। রাজ্যের হাজার বছরের পুরনো তাঁত শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে চলেছে। ঐতিহ্যশালী তাঁত শিল্প আধুনিকতার যুগে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে হুগলি জেলার প্রাচীনতম তাঁত শিল্প। হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার চণ্ডীতলা থানার অধীনে বেগমপুরে তাঁত শিল্পের জন্য সুবিখ্যাত ছিল। নদিয়া ও হুগলি জেলার তাঁতের জনপ্রিয়তা একসময় ছিল অনেক বেশি। বিশেষত হুগলির ধনিয়াখালি, আটপুর, নসীবপুর,আরামবাগ, গোঘাট, গুপ্তিপাড়া ও বেগমপুরের তাঁতের আলাদা কদর ছিল শাড়ি প্রেমীদের কাছে। প্রায় ১০০০ বছরের পুরনো তাঁত শিল্প এখন প্রায় উঠতে বসেছে।
হালকা এবং উজ্জ্বল বলে এই বেগমপুরি তাঁতের বরাবরই একটা কদর রয়েছে। বেগমপুরি শাড়ির কথা হয়ত আমরা অনেকেই শুনেছি। কিন্তু আগামী দিনে আদৌ এই বেগমপুরি শাড়ি থাকবে কিনা এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার তাঁত শিল্পীদের করুণ ছবি উঠে এল এলাকায় পৌছাতেই। শারদউৎসবের বাকি হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটা দিন। কিন্তু হাসি নেই তাঁতশিল্পীদের মুখে। অধিকাংশ শিল্পীই প্রবীণ। তাদের উত্তরসূরি বলে কেউ নেই। তাঁত বুনে পেট চলেনা। তাই অনেকেই ভিড়ে গিয়েছে অন্য পেশায়। ডানকুনি শিল্পাঞ্চলে কলকারখানায় কাজ জোটাতে তাঁরা ব্যস্ত।
প্রবীন এক তাঁত শিল্পীর বক্তব্য, ‘‘মহাজন কাঁচামাল দিয়ে যায়। ১২হাতের একটি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে ২ দিন। মজুরি ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। শেয়ার বাজারের মতো রেট ওঠানামা করে। দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে দৈনিক রোজগার ৮০ কি ৯০ টাকা। এই পয়সাব কি করে সংসার চলবে? দেখার কেউ নেই। সমস্যা সমাধানের জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। প্রয়োজন মজুরি বৃদ্ধির।
একসময় যে এলাকায় ৩৫ হাজার তাঁত চলতো, এলাকায় পা রাখা মাত্রই রাস্তার দুদিকের বাড়ি থেকে ভেসে আসত তাঁত মেশিনের খটখট শব্দ। এখন সে জায়গায় মেরে কেটে ৫০০ তাঁত চলে কিনা সন্দেহ। তবুও ঘষে যাওয়া চশমা মুছে, তাঁরা বুনে চলেছেন তাঁতিরা। বৃদ্ধ তাঁতি তাঁর সহধর্মিণীকে পাশে রেখে তাঁত বুনে যান। সপ্তাহে চারটের বেশি শাড়ি তৈরি হয়ে ওঠেনা। কোভিডের আগে যেখানে ২৩০ টাকা মজুরি ছিল শাড়ি প্রতি সেখানে এখন শাড়ি প্রতি মজুরি এসে দাঁড়িয়েছে ১৮০ টাকা। তাঁত শিল্পের সুদিন কি আর ফিরে আসবে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁতশিল্পীরা। সরকারি সাহায্যের আশায় আজও রয়েছে তাঁত শিল্পীরা।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় কালে তাঁত শিল্পীদের নিয়ে সমবায় বাঁচানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব অরূপ দাস জানান, বামফ্রন্ট সময়ে সমবায়ের মাধ্যমে ভর্তুকি দেওয়া হতো। ব্যবস্থা ছিলো পেনসনের, তার সাথে শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য শিল্পীদের দেওয়া হতো চরকা ও তাঁতের মেশিন। যদিও সে সময় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এই শিল্প বাঁচানোর জন্য ভর্তুকি দিত। যা ২০১০ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার কমাতে শুরু করে। আর এখন একেবাই বন্ধ।
Comments :0