প্রতিদিনের জীবনে যা ভারতবাসী যা বুঝতে পারছিলেন, এবার তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে সেকথাটাই প্রমাণ করে দেখালো ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব। প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণারত বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের থেকেও বর্তমান ভারতে এখন আর্থিক অসাম্য বেশি। ভারতে এখন ‘আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণি’র নেতৃত্বে ‘ধনকুবেরদের রাজত্ব’ বা ‘বিলিয়নেয়ার রাজ’ চলছে বলে তাদের গবেষণা রিপোর্টে দাবি করেছেন বিশিষ্ট চার অর্থনীতিবিদ। তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে ভারতে ধীরে ধীরে ধনীদের শাসন বা ‘প্লুটোক্রেসি’ কায়েম হতে পারে।
ব্রিটিশ রাজে ভারত কীভাবে লুণ্ঠিত হয়েছিল এবং অসাম্য তৈরি হয়েছিল তা ইতিহাসে লেখা আছে। কিন্তু স্বাধীন ভারতে, বিশেষত গত চল্লিশ বছরে অসাম্য বৃদ্ধি তাৎপর্য্যপূর্ণ। কারণ এই অসাম্য বৃদ্ধি স্বাধীনতার সাফল্যকে ম্লান করে দেয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের গৌরবকে ম্লান করে দেয়। মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ও অন্যান্য প্রয়োজনকে অস্বীকার করছে ক্রমবর্ধমান অসাম্য।
‘ভারতের আর্থিক অসাম্য: ধনকুবেরদের রাজত্বে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের থেকেও বেশি অসাম্য’ শিরোনামের রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের চার অর্থনীতিবিদ। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি, নিতিনকুমার ভারতি, লুকাস চ্যানসেল ও আনমল সোমাঞ্চির তৈরি করা এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে ভারতের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশই ধনীতম ১ শতাংশ ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত ছিল। দেশের মোট আয়ে তাঁদের ভাগ ২২ শতাংশের বেশি। আমেরিকা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশেও জাতীয় আয়ে ধনীতমদের ভাগ এত বেশি নয়। আয়ের দিক থেকে তলার সারির ৫০ শতাংশ বা দেশের অর্ধেক মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। অথচ বিত্তের বিচারে একেবারে উপরের ১ শতাংশ মানুষের গড় আয় বছরে ৫৩ লক্ষ টাকা। গড়পরতা ভারতীয়ের আয়ের ২৩ গুণ। সেখানে নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের গড় আয় মাত্র ৭১ হাজার টাকা। আর মাঝের সারির ৪০ শতাংশ মানুষের গড় আয় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। আবার উপরের দিকের ধনী ১০ হাজার ব্যক্তির গড় আয় বছরে ৪৮ কোটি টাকা। গড়পরতা মানুষের আয়ের দু’হাজার গুণেরও বেশি আয় তাঁদের। এটাই হলো ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমানের কুৎসিততম চেহারা।
মোদী সরকার এবং বিজেপি দেশজুড়ে বিকাশের গল্প প্রচার করে চলেছে। দারিদ্র ঘুচেছে বোঝাতে একদিকে তথ্য সংগ্রহের মাপকাঠির বদল ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে আইটি সেলকে দিয়ে। কিন্তু এর আগে অক্সফামের রিপোর্টে ভারতের প্রকৃত চিত্রের ভিন্নরকমের আভাস পাওয়া গেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ভারতের ৯৮ জন ধনীশ্রেষ্ঠর সম্পদ সম্মিলিতভাবে ৬৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা অর্থনৈতিক পিরামিডের নিচে থাকা ভারতের ৫৫২ বিলিয়ন দরিদ্রতম মানুষের মালিকানাধীন সম্পদের সমান। অক্সফামের অসমতা প্রতিবেদনে আরও দেখানো হয়েছে যে ভারতের ডলার বিলিওনিয়ার যাদের মোট সম্পদ ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি তাদের সংখ্যা ২০২০ সালে ছিল ১০২ এবং ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৪২, আর জাতীয় সম্পদে জনসংখ্যার নিচের ৫০ শতাংশের ভাগ ৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
এখন প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের অসাম্যের রিপোর্টে স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অসাম্যের চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং বিজেপি আরএসএস নেতারা কথায় কথায় স্বাধীনতার পর থেকে এমনকি বর্তমান সময় পর্যন্ত যাবতীয় দুর্গতির পিছনে জওহরলাল নেহরু এবং বামপন্থীদের চিন্তাভাবনাকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু রিপোর্ট বলছে, উলটো কথা। স্বাধীনতার পরে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার যেটুকু রূপায়ণ ঘটেছিল তারই সুফল দেখা গেছিল অসাম্য দূরীকরণে। মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং উদারনীতির রূপায়ণ অসাম্যকে চুড়োয় নিয়ে গেছে। প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের গবেষণাপত্র বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকের গোড়া পর্যন্ত অসাম্য কমেছিল। তার পরে তা বাড়তে শুরু করে। ভারতে উদারনীতির রূপায়নে তা ক্রমশ বেড়েছ এবং একবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে তা রকেটের গতিতে বেড়েছে। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে অসাম্য সর্বোচ্চ হয়েছে, এমনকি ব্রিটিশ আমলের থেকেও বেশি। দেশের মোট আয়ে ধনীতম ১ শতাংশ ব্যক্তির ভাগ ২২.৬ শতাংশ আর দেশের মোট সম্পদে তাঁদের ভাগ ৪০.১ শতাংশ।
গবেষকদের মতে, দেশের নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষ ও মাঝের সারির ৪০ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পিছনে থেকে গিয়েছেন। কারণ, সকলের জন্য উঁচু মানের শিক্ষার ব্যবস্থা হয়নি। জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বদলে রাষ্ট্র সমাজের উপতলার মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে গিয়েছে। ভারতের কর ব্যবস্থাও গরিবদের উপরে বেশি বোঝা চাপিয়েছে।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট কর্পোরেট বা ধনীদের বিপুল টাকা সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রভাবিত করছে। ধনীদের টাকায় নির্বাচিতরা ধনীদের স্বার্থেই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থা পরিচালনা করলে অসাম্য কাটবে কী করে? বরং এর ফলে গণতন্ত্রের মূল ভাবনাই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী নয়, মুষ্টিমেয় ধনীরাই দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। টমাস পিকেটি সহ অর্থনীতিবিদরা এটাকেই প্লুটোক্রেসি বলে অভিহিত করেছেন। ভারতবাসীর স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে যাবে এতে। যে কর্পোরেট ধনীরা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সংসদ, সরকার এবং প্রশাসনের নীতিগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে তারা গণতন্ত্রের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলিকে ছাড় দেবে এমন বিশ্বাসের কোনও মানে নেই। ফলে ভারতের সংবিধানের গণতন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এর বিরুদ্ধে কি দেশবাসী প্রতিবাদ করবে না? অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে স্বাভাবিক বলে প্রায় দুশো বছর আগেই দেখিয়েছিলেন কার্ল মার্কস। এমনকি ভারতে ব্রিটিশরাজের লুণ্ঠন ও অসাম্য তৈরির দিকে তিনিই দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে দিয়েছিলেন। পুঁজি গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “আমেরিকায় সোনা ও রুপা আবিষ্কৃত হওয়া, সেখানকার আদিবাসীদের প্রথমে উচ্ছেদ ও পরে দাসে পরিণত করার মাধ্যমে খনির অন্ধকারে সমাধিস্থ করে, ভারত ও পূর্ব-এশিয়াতে লুঠতরাজ চালিয়ে এবং কালো চামড়ার মানুষদের ব্যবসার পণ্যে পরিণত করতে আফ্রিকাকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই পুঁজিবাদের গোলাপবিছানো ঊষালগ্নের সুত্রপাত। পূঁজির আদিম সঞ্চয়ে প্রাণ সঞ্চারিত করতে প্রধান উপায়গুলি ছিল এমনই সব মনোরম প্রক্রিয়া।’ পুঁজি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে ১৮৫৫ সাল নাগাদ ভারত থেকে নজরানা বাবদ ব্রিটেনের আদায়ের পরিমাণ প্রায় ৫ মিলিয়ন পাউন্ড। তৎকালীন সময়কালের হিসাবে এই টাকা কম নয়। মার্কসের হিসাবে-‘ভারতীয়রা প্রতি বছর ইংলন্ডে বহুল পরিমানে সম্পদ পাঠিয়েই চলেছে– সেদেশে কৃষিকাজ ও শিল্পগুলিতে খেটে চলা ৬ কোটি মজদুরদের মোট রোজগারের থেকেও সেই নজরানার পরিমাণ বেশি।’ এসব দেখেই ভারতবাসীর প্রতিবাদের আগাম অনুমান করেছিলেন এবং ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ দেখে তিনি সেটাকে ভারতবাসীর ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেন। সেই ব্রিটিশ আমলের থেকেও মোদী আমলে ভারতবাসীকে অর্থনৈতিকভাবে বেশি অসহায় বলে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক রিপোর্টে।
বর্তমান সময়ের অসাম্যের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ নিশ্চিত। কিন্তু প্রতিবাদ বিক্ষোভকে সফল হতে হলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সংগঠিত হতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো নৈরাজ্য তো কোনো সমাধান আনতে পারে না। সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা তাই বারবার দাবি করেছেন, মানুষের দারিদ্র দূর করতে হলে, সমতা ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই রাষ্ট্রকে জনকল্যাণে ব্যয় করতে হবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা খাদ্য, কাজ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। এরজন্য জনকল্যাণে বিপুল খরচ করতে হবে এই ভয়ে পিছিয়ে এলে চলবে না। সেই টাকা কোথা থেকে সংগ্রহ করা যাবে? সেই পথ উল্লেখ করে সিপিআই(এম) তাদের পাঁচবছর আগের লোকসভা নির্বাচনের ইশ্তেহারেই বলেছিল, সুপাররিচ যে তৈরি হচ্ছে তথ্য পরিসংখ্যানে তা নিশ্চিত। তাহলে এখনই এই সুপাররিচদের ওপরে কর বসিয়ে, সেই টাকায় জনকল্যাণ করতে হবে।
এখন প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্সের গবেষণা রিপোর্টের লেখক টমাস পিকেটি সহ অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, ভারতের ১৬৭টি ধনীতম পরিবারের উপরে ২ শতাংশ সম্পদ কর বসানো হোক। তাতে যে সরকারি আয় হবে, তা কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিতে সকলের জন্য সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হোক। তাহলেই সবাই সুফল পাবেন।
Comments :0