CAG

দুর্নীতিতে ‘উঁচু মাথা’, আমলাতন্ত্র জড়িয়ে থাকার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে

রাজ্য

প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী একা নন, রেশন দুর্নীতির পিছনে সরকারের আরও ‘উঁচু মাথা’ সহ আমলাতন্ত্রকে জড়িয়ে তৈরি দুর্নীতিচক্রের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৬-১৭ সালে দায়িত্বে থাকা খাদ্য সচিব এবং মুখ্যসচিবকে জেরা করে সেই ‘উঁচু মাথা’কে কেন ধরা হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ সেই সময়ে দুই শীর্ষ আধিকারিকই সিএজি-কে নিয়মমাফিক হিসাব পরীক্ষায় বাধা দিয়েছিলেন, তথ্য পর্যন্ত দেননি। সিএজি’র পক্ষ থেকে সেকথা স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিএজি-কে যদি স্বাভাবিক আইন মেনে অডিট করতে দেওয়া হতো, তাহলে অনেক আগেই এই দুর্নীতিচক্র ভেঙে দেওয়া যেত বলে মনে করছেন অনেকে।
রেশনে সরবরাহের খাদ্যপণ্য বাইরে বিক্রি করে যে কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ইডি করছে সেটার ইঙ্গিত পাঁচ বছর আগেই পাওয়া গিয়েছিল। তথ্যের অধিকার আইন নিয়ে কর্মরত সমাজকর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী আরটিআই করে রাজ্য সরকারের ট্রেজারি এবং বিভিন্ন দপ্তরের কাছে প্রশ্ন পাঠালেও জবাব পাননি। কিন্তু সিএজি’র কাছে প্রশ্ন পাঠিয়ে জবাব পেয়েছিলেন। সিএজি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল, ‘২/৯/২০১৬ থেকে ১৩/১২/২০১৬ তারিখের মধ্যে খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের প্রধান সচিবের কাছে রেশন কার্ডের ডিজিটাইজেশন সম্পর্কে লিখিতভাবে বারবার তথ্য চাইলেও কোনও কিছু পাওয়া যায়নি। ৩০/৩/২০১৭ তারিখে মুখ্যসচিবের কাছে লিখিতভাবে জানতে চাইলেও তথ্য পাঠানো হয়নি।’
গণশক্তি পত্রিকার হাতে ২০২১ সালেই সিএজি’র এই জবাব এসেছিল এবং গণশক্তি ওই বছরেরই ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, ‘‘কখনও নিরাপত্তা আবার কখনও গোপনীয়তার অজুহাতে সিএজি-কে তথ্য জানাতে অস্বীকার করেছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। ফলে ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজসাথী’, গণবণ্টন সহ রাজ্যের প্রায় ৭০টি প্রকল্পের হিসাব পরীক্ষাই করতে পারেনি সিএজি।’’ তখনই বিশ্বনাথ গোস্বামী সিএজি’র পাঠানো জবাবের ভিত্তিতে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে চিঠি পাঠিয়ে আর্থিক বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন। গোস্বামী জানাচ্ছেন, ‘‘রাজ্যপাল ধনকড় অনেক বিষয়ে হম্বিতম্বি করতেন, কিন্তু এই বিষয়ে কোনও হস্তক্ষেপই করেননি। করলে দুর্নীতি আরও আগেই প্রকাশ্যে আসতো।’’
সরকারি হিসাব পরীক্ষণে সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সিএজি সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়, তার কাছে তথ্য গোপন করাকে সরাসরি সংবিধান অমান্য করা বলেই মনে করছেন আইনজ্ঞরা। হিসাব ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সংবিধান অনুসারে সিএজি-কে সব হিসাব পরীক্ষা করতে দিতে সরকার বাধ্য এবং সেই রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করতে বাধ্য। এই প্রক্রিয়াই বছরের পর বছর এড়ানো হয়েছে এরাজ্যে। 
কিন্তু রাজ্য সরকারের তদানীন্তন খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের সচিব এবং মুখ্যসচিব কি নিজেরাই যুক্ত ছিলেন দুর্নীতিতে? নাকি মুখ্যসচিব আরও উপরের নির্দেশে সিএজি-কে তথ্য দিতে অস্বীকার করেছিলেন? ইডি দুর্নীতির অভিযোগও তুলবে, অথচ এই প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার জন্য সক্রিয় হবে না, এমন তদন্তকে লোকদেখানো বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কেবল প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে এই মূল প্রশ্নগুলো ধামাচাপা দেওয়া যায় না। বিশ্বনাথ গোস্বামীর মতে, ‘‘একসময়ের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের সচিব অনিল ভার্মার সঙ্গে কী নিয়ে বিবাদ হয়েছিল মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের যার জন্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সচিবকে? তৎকালীন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় কার নির্দেশে সিএজি-কে অডিট করতে বাধা দিয়েছিলেন? মুখ্যমন্ত্রীর কী ভূমিকা ছিল? এসবই তো তদন্ত করে দেখা দরকার।’’ লক্ষণীয় যে, এই বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কেই পরবর্তীকালে মুখ্য তথ্য কমিশনার পদে বসিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেটা কি তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার জন্য? রাজ্যের সমস্ত রকম দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির পিছনে বেশ উর্বর মাথা এবং অক্টোপাসের মতো বহু হাত রয়েছে, এদের সকলকে প্রয়োজনে হেপাজতে নিয়ে তদন্ত করা দরকার। নইলে এই মরুভূমির মতো বিস্তৃত, পর্বতের মতো উঁচু এবং মহাসমুদ্রের মতো গভীর দুর্নীতির তল পাওয়া যাবে না।’’ 
সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম আগেই অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা উচ্চপদস্থ পুলিশ ও আমলাদের একাংশকে জড়িয়ে নিয়ে দুর্নীতিতন্ত্র কায়েম করেছে এবং সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠরোধ করতে দুষ্কৃতীতন্ত্রকে জড়িয়ে নিয়েছে।’ সিএজি’র জবাব সেটাই ইঙ্গিত করছে। সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী শনিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘সিএজি বারবার তথ্য চাওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকার নির্বিকার থেকেছে লুটকে চলতে দেওয়ার জন্য, কাজেই এই দুর্নীতির দায় মুখ্যমন্ত্রী এড়াতে পারেন না।’’ 
তিনি আরও বলেছেন, ‘‘সিএজি’র প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত একা খাদ্য সচিবের হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী বা মুখ্যসচিব দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। তদানীন্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তো অপরাধী বটেই। কিন্তু জ্যোতিপ্রিয়র পিছনে লুটের ভাগ পেত কে কে? জ্যোতিপ্রিয়কে কেন দীর্ঘদিন খাদ্য মন্ত্রীর পদে রাখা হয়েছিল? মুখ্যমন্ত্রী বারবার দাবি করেছেন যে তিনি রাজ্যের ১০ কোটি মানুষকে রেশন দেন। অথচ সাড়ে সাত কোটির বেশি মানুষ রেশন নেন না। তাহলে আড়াই কোটি মানুষের রেশন লুটপাটের ভাগ নিল কে? এই সব প্রশ্নের জবাব চাই।’’

 

Comments :0

Login to leave a comment