বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ মসজিদই কি না স্থির করবে আদালত। মঙ্গলবার এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছে, জ্ঞানবাপী পরিসরের ‘ধর্মীয় চরিত্র’ স্থির করবে বারাণসী দেওয়ানি আদালত। প্রামাণিক নথি এবং কথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বারাণসীর দেওয়ানি আদালত জ্ঞানবাপীর ধর্মীয় চরিত্র স্থির করা হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আদালত বিচারপূর্বক তা স্থির করছে ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানবাপীকে মন্দির বা মসজিদ বলা যাবে না। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি রোহিত রঞ্জন আগরওয়াল এদিন একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, এই নিয়ে ১৯৯১ সালে বারাণসী দেওয়ানি আদালতে জমা পড়া আবেদনেরও শুনানির ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন। এমনকি বারাণসীর আদালত মনে করলে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে আরও সমীক্ষার নির্দেশ দিতে পারে বলেও জানিয়েছে হাইকোর্ট।
বারাণসী দেওয়ানি আদালতে ৩২ বছর আগের আবেদনে বলা হয়েছিল, জ্ঞানবাপী মসজিদে হিন্দুদের পুজোর অধিকার এবং জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে মন্দিরের সংস্কারের আবেদন জানানো হয়েছিল। এই আবেদন জানানো হয়েছিল স্বয়ম্ভূ ভগবান বিশ্বেশ্বরের নামে। সোমনাথ ব্যাস, রামরঙ্গ শর্মা এবং হরিহর পান্ডে এই মামলায় বাদী ছিলেন। আবেদন দাখিলের পরে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উপাসনাস্থল আইন তৈরি হয়েছিল। সেই আইনে বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যে উপাসনাস্থলের যে চরিত্র ছিল, তাকে সেই অবস্থায় রাখতে হবে। বদল করা যাবে না। কেউ সেই চেষ্টা করলে তিন বছর জেল এবং জরিমানা হতে পারে। বাবরি মসজিদ- রামজন্মভূমি জমি বিবাদের জেরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই আইন তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময়ে আদালতের বিচারাধীন ছিল বলে বাবরি মসজিদকে বাদ দেওয়া হয়েছিল এর আওতা থেকে। এই আইনের জেরেই মসজিদ কমিটি হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট জ্ঞানবাপী মসজিদে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। ২০১৮ সালে এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় কোনও মামলায় স্থিতাবস্থা ছয় মাসের বেশি কার্যকর হয় না। এরপর ওই নির্দেশের বৈধতা থাকে না। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার জমি ‘রামলালা বিরাজমান’কে দিয়ে দেওয়ার পরে হিন্দুত্ববাদীরা ফের কাশী, মথুরা নিয়ে আসরে নামে। বারাণসীর আদালতে পাঁচ মহিলাকে দিয়ে আবেদন করানো হয়। আদালত জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে সমীক্ষার নির্দেশ দেয়। এর প্রতিবাদে হাইকোর্টে আবেদন করার সময়ে জ্ঞানবাপী মসজিদ কমিটি ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইনের উল্লেখ করে বিরোধিতা করেছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই এলাহাবাদ হাইকোর্ট এদিনের নির্দেশ দিয়েছে।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট এদিন তাৎর্যপূর্ণভাবে বলেছে, যেহেতু আইনে ‘ধর্মীয় চরিত্র’ সংজ্ঞায়িত করা হয়নি এবং একই সঙ্গে ওই স্থানের দ্বৈত ধর্মীয় চরিত্র থাকতে পারে না। হয় স্থানটি মন্দির অথবা মসজিদ। সমগ্র জ্ঞানবাপী পরিসরের ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণ করার পরে বলা যাবে সেটির ধর্মীয় চরিত্র। ফলে এই ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন লঙ্ঘন করা হয়নি। আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে। এই নির্দেশের ফলে জ্ঞানবাপীকে ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থল আইনের আওতা থেকেই বের করে দেওয়া হলো। এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বারাণসীর দেওয়ানি আদালত যদি এখন বলে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট জ্ঞানবাপী মসজিদ ছিল না, তাহলেই সেই ক্ষেত্রে আর ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থল আইন কার্যকরী হবে না। তার জেরে জ্ঞানবাপী মসজিদের ‘ধর্মীয় চরিত্র’ও বদল করে দেওয়া যেতে পারে। বারাণসী আদালতকে প্রামাণিক তথ্যের ভিত্তিতে যে বিচার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার অন্যতম উপাদান হতে চলেছে এএসআইয়ের রিপোর্ট। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সন্দেহের কারণের পিছনে রয়েছে অযোধ্যায় এএসআইয়ের ২০০৩ সালের খননের ভূমিকা। ফলে এদিনের রায় নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা উল্লসিত। একান্ত আলোচনায় তারা বলছে, অযোধ্যার মতোই জ্ঞানবাপীও আমরা আদালতের নির্দেশেই বের করে নেব।
১৯৯১ সালে যে আবেদনগুলি করা হয়েছিল সেগুলি ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থল আইনের ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী বাধা দেওয়া যায় না এবং সিপিসি’র আওতায় আবেদন খারিজ করা যায় না। অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদ কমিটি ১৯৩৬ সালের দীন মহম্মদ মামলার উল্লেখ করে বলেছে জ্ঞানবাপীর ধর্মীয় চরিত্র নতুন করে স্থির করার কিছু নেই, তা আগে থেকেই স্থির হয়ে আছে। ফলে বারাণসীর দেওয়ানি আদালতের নতুন করে স্থির করার সুযোগ নেই। আদালত পালটা বলেছে, দীন মহম্মদের মামলায় জ্ঞানবাপীর ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে কিছু বলা হয়নি। শুধু আবেদনকারীদের সেখানে নমাজ পাঠের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছে, জ্ঞানবাপী বিতর্ক দুই জন ব্যক্তির মধ্যের বিষয় নয়, এটা দেশের দুটি সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে। বারাণসী দেওয়ানি আদালতকে ৬ মাসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে সর্বাধিক আগ্রহ নিয়ে। দীর্ঘসূত্র করার কোনও কৌশল না নিয়ে মামলার পক্ষদেরও সহযোগিতা করতে বলেছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। এএসআই যে সমীক্ষা করেছে, সেই সমীক্ষা রিপোর্টের পরেও বারাণসীর দেওয়ানি আদালত যদি মনে করে ন্যায়বিচারের জন্য আরও সমীক্ষার প্রয়োজন আছে তাহলে এএসআইকে দিয়ে ওই পরিসরে সেটাও করাতে পারবে।
Comments :0