Pikepur

মন্ত্রী-বিধায়কের এলাকাতেই ভেঙে পড়েছে গর্বের চার স্তম্ভ

রাজ্য পঞ্চায়েত ২০২৩

রণদীপ মিত্র: পাইকর 
 

প্রত্যেক দিন সকাল হলেই ভীমপুর থেকে পনেরো কিমি দূরে মুরারই আসেন তোহিদুল খান। বসার সিটের পাশেই রেখেছেন এক গোছা নমুনা ব্যালট। পেট চালানোর দায়ে টোটো চালানোর সঙ্গে সঙ্গে করছেন ভোট প্রচারও। সাহস নিয়েই। কার হয়ে প্রচার করছেন?  জোর গলায় উত্তর,‘সিপেম আর হাতের।’ 
কেন?  
টোটো নিয়ে মুরারই থেকে হরিশপুর যেতে যেতেই তোহিদুল দেওয়াল দেখিয়ে দেখিয়ে গজগজ করতে লাগলেন। পলসা, কান্দা, নন্দীগ্রাম, কনকপুর, ভীমপুর, কাশিমডাঙা দেওয়ালে কোথাও আম, কোথাও নলকূপ, কোথাও মোবাইল তো বাল্ব চিহ্ন নিয়ে বহু প্রার্থীর দেওয়াল লিখন। তোহিদুল সেই দেওয়াল দেখিয়েই উগড়ে দিলেন ক্ষোভ,‘‘লুটে খাওয়ার জন্য তাগিদ দেখছেন। এরা সব তৃণমূল। টিকিট না পেয়েই হয়েছে নির্দল। অথচ রাস্তা দেখছেন। যাতায়াত করতে মাজা ভেঙে যায়। তা সারানোর তাগিদ নেই।’’
গ্রামগুলি পাইকর ব্লকে। সেখানে শুধু কি আম, বাল্ব, মোবাইল নিয়ে গোঁজ হয়েছেন তৃণমূলীরা? না। পদ্মও আঁকড়ে ধরেছেন শাসকদলের প্রাক্তন মাতব্বররা। আমডোল গ্রামের সিপিআই(এম) প্রার্থী জিন্নাতুল বিবির হয়ে গলা ফাটাতে ফাটাতে লতিব শেখ জানিয়েছেন,‘‘আমাদের গাঁয়ে বিজেপির প্রার্থী কে জানেন? নাটুর বউ। নাটুই তো ছিল গাঁয়ে তৃণমূলের সব। লুটেপুটে খেয়েছে। মানুষ খেপে গিয়েছে তার উপর। তাই তো ভয়ে তৃণমূল তাকে আর প্রার্থী করার সাহস করেনি। তাই নাটু ঢুকে গিয়েছে বিজেপিতে।’’ শুধু কি নাটু, উত্তর রামচন্দ্রপুরও রেখেছে একই নজির। তৃণমূলের প্রাক্তন মেম্বর দলবল নিয়ে ভিড়েছেন বিজেপি-তে। ঠিক করেছেন পদ্ম প্রার্থী। 
তৃণমূল থেকে বিজেপি’র প্রার্থী হওয়া নাটুর কীর্তি শুনলে চমকে যেতে হয়। বিস্তীর্ণ এলাকার পড়াশোনার একমাত্র ভরসা আমডোল হাই স্কুল। সাতশোর বেশি পড়ুয়া। স্কুলে আসে মেরে কেটে দেড়শো। কারণ শিক্ষক সংখ্যা পাঁচ। পড়াশোনা উঠেছে লাটে, বরং জায়গা পেয়ে লুট। তারই মাথা ছিল তৃণমূল নেতা নাটু। গ্রামেরই সুকদিন শেখের কথায়,‘‘নাটু তো হেড মাস্টার হয়ে গিয়েছিল। আসল মাস্টারদের কোনও দাম ছিল না। নাটুই তো সব চালাতো। সেই নাটুর মদতে মিড ডে মিলের ৮০ বস্তা চাল চুরি হাতে নাতে ধরেছিল গ্রামের মানুষ।’’
শুধু কি শিক্ষার ডামাডোল? বেহাল অবস্থা স্বাস্থ্যেরও। এক সময় গ্রামের গর্ব ছিল ভীমপুর হাসপাতাল। এলাকার বারো-পনেরো গ্রাম ছাড়াও পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের নির্ভরতা ছিল ভীমপুর হাসপাতাল। যেখানে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত হত। ছিল অপারেশন থিয়েটার। আজ সামান্য জ্বরজ্বালাতেও চলে ‘রেফার’।  ভগ্নদশা হাসপাতালের। ভেঙে পড়ছে হাসপাতালের ঘর। এলাকার বাসিন্দা মহীউদ্দীনের ক্ষোভ,‘‘হাসপাতাল সাজানো তো দূর, হাসপাতালের গাছ কেটে বেচে দিচ্ছে।’’
তৃণমূলের মুরারইয়ের বিধায়ক মোশারফ হোসেনের বাড়ি এই এলাকাতেই। রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথেরও গ্রাম এই অঞ্চলের কলহপুরে। মন্ত্রী-বিধায়কের তল্লাটেই ক্ষোভের আঁচ তুঙ্গে। 
হবে নাই বা কেন? চার স্তম্ভের উপর ভর করে মাথা তুলেছিল এলাকা। সেই চার স্তম্ভ হল, স্কুল-হাসপাতাল-সমবায়- সেচ। স্কুলে ডামাডোল। ধুঁকছে শিক্ষকের অভাবে। হয়ে উঠেছে লুটের আখড়া। হাসপাতাল কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রইল সেচ। তা নিয়ে এলাকার কী অভিজ্ঞতা?  এলাকার বুক চিরে বইয়ে চলা বাঁশলৈ নদীবক্ষে তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েকটি রিভার পাম্প। বাসিন্দা অধীর রাজবংশীর কথায়,‘‘আগে বছরের পর বছর এলাকার মানুষকে চাষ নিয়ে নিশ্চিন্ত রাখত এই রিভার পাম্পগুলি। এখন প্রায় সবকটি বিকল। মোটা টাকা খসিয়ে শ্যালো থেকে জল কিনে চষতে হচ্ছে জমি। লাভের গুড় পিঁপড়েতে খাচ্ছে।’’ দুর্ভোগের শেষ নয় এখানেই। যেমন সমবায়। সমিতির এক গ্রাহক সাইদা সাহানার কথায়, ‘‘আগে সমিতি গমগম করত। মিলত কম পয়সায় সার। দেওয়া হত গাছের চারা। এখন একমাত্র কর্মী নামমাত্র সমিতির দরজা খোলে আর বন্ধ করে।’’ 
তাই তো এই চার স্তম্ভকে ফের মাথা তুলে দাঁড় করানোর শপথ নিয়েছেন আজফার, সঞ্জয়, সরিফারা। লড়ছেন লালঝান্ডার হয়ে। আর কান্দা থেকে নন্দীগ্রামের রাস্তায় প্রচার করা তৃণমূল প্রার্থীকে এক বাসিন্দার উদ্দেশে বলতে শোনা গেছে,‘‘তৃণমূলকেই ভোট দিও। না হলে লক্ষ্ণীর ভান্ডার বন্ধ হয়ে যাবে।’’

 

Comments :0

Login to leave a comment