DROHER CARNIVAL

পুঞ্জীভূত ক্ষোভের দ্রোহপথ লিখে নিল নতুন ইতিহাস

রাজ্য কলকাতা

প্রতীম দে

‘‘মানুষ ইতিহাস রচনা করেন।’’ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর এই কথা প্রতিটাক্ষনে বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে মিলে যাচ্ছে।
অন্যায় অবিচার দেখতে দেখতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা গোটা সমাজ আজ রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে, তর্জনী উঁচিয়ে পুলিশের দিকে তারা স্লোগান ছুঁড়ে দিচ্ছে ‘শাসক তোমার কিসের ভয়, ধর্ষক তোমার কে হয়?’
গত ৯ আগস্ট আর জি কর হাসপাতালের ঘটনা রাজ্যের মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ বাইরে নিয়ে এসেছে। আর তাই ‘দ্রোহের উৎসবে’ সামিল হয়েছেন তারা। শারিরীক প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে বহু মানুষ এসে জড়ো হচ্ছেন ধর্মতলায়। চিকিৎসক সমাজের ডাকে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। কারণ এই লড়াই একা চিকিৎসকদের নয়। গোটা সমাজের। আর তাই বেলভিউ হাসপাতালে থেকে চোখে দেখি হুইল চেয়ারে করে দ্রোহের কার্নিভালে যোগ দেওয়ার জন্য এসেছেন সোনারপুরের লীনা ঘোষ।
কথা বলতে বলতে ওই মহিলা বলেন, ‘‘আমি ডাক্তার দেখিয়ে এখানে আসছি। যারা আমাদের চিকিৎসা করে তাদের ডাকে আসবো না তা হয়?’’ সোনারপুর থেকে গাড়ি করে এসেছিলেন বেলভিউ। সেখান থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার স্বামী। তিনি বলেন, ‘‘দুজনের বয়স হয়েছে। শরীর সব সময় ঠিক থাকে না। কিন্তু আজ না এসে পারলাম না। আগের থেকেই ঠিক করেছিলাম ডাক্তার দেখিয়ে এখানে আসবো।’’ 
পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে যখন তারা এই কথা গুলো বলছেন তখন ইডেনের সামনে দিয়ে একের পর এক ট্যাবলো যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর কার্নিভালে। আলোয় উজ্জ্বল ট্যাব্লো যেন তখন ফিকে ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর চোখের কাছে।
দুই দিক থেকেই ঢাকের আওয়াজ আসছে। কিন্তু কোথাও যেন মানুষের করের টাকা খরচ করে গায়ের জোড়ে উৎসবের আওয়াজ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। জয়েন্ট প্ল্যাট ফর্ম অফ ডক্টরস এর ডাকা দ্রোহের কার্নিভাল যাতে কোন ভাবে না হয় তার জন্য ১৬৩ ধারা জারি করেছিল কলকাতা পুলিশ। হাইকোর্টের রায়ে সরকার বাধ্য হয় এই নির্দেশিকা প্রত্যাহার করতে। বড় বড় লোহার ব্যারিকেড তারা সড়িয়ে নেয়। তবে পুলিশের জন্য মঙ্গলবার অপেক্ষা করেনি মানুষ। দ্রোহের কার্নিভালে যোগ দেওয়ার জন্য বেলা থেকেই ধর্মতলায় ভির জমতে শুরু করেছিল।  মুহূর্তের মধ্যে ধর্মতলা, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের দখল নিয়েছিল মানুষ। শহর কলকাতার বুকে নতুন করে শুরু হলো ইতিহাস লেখা। 
ঢাক বাজছে, স্লোগান উঠছে আর জি কর, জয়নগরের বিচার চাই। ছোট ছোট মিছিল করে লোক আসছে সোনারপুর, পানিহাটি, বর্ধমান থেকে। কারুর হাতে নেতাজির ছবি, কারুর হাতে কাদম্বিনী বসু’র। তলায় লেখা এই বাংলায় ধর্ষকদের ঠাই নাই। মানুষের ভির এতটাই ছিল যে একটা সময় ডোরিনা ক্রসিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল পুলিশ। মানুষের দখলে তখন রাস্তা।
স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেখা গিয়েছিল শঙ্খ বাজিয়ে মহিলারা আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছেন। মঙ্গলবার ধর্মতলা দেখলো  একই ছবি। শঙ্খের আওয়াজ আর আকাশে প্রতিবাদের কালো বেলুন দেখিয়ে দিল এই শহর প্রতিবাদের ভাষা ভোলেনি। 
উত্তরপাড়া থেকে আসা একজন চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমি পেশায় একজন চিকিৎসক। এক মেয়ের বাবা। আজ আমাদের চিন্তা হয় কোন জায়গায় সমাজ চলে যাচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মকে কি দিয়ে যাবো আমরা?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ইতিহাসের পাতায় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পড়েছিলাম এই ধরনের গণ-জাগরনের কথা আজ তার সাক্ষী থাকছি। আজ যদি বাড়িতে থাকি তাহলে তো আমাদের পরের প্রজন্ম আমাদের ছেড়ে দেবে না।’’
গত বছর চাকরি প্রার্থীদের ধর্ণা মঞ্চ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল সরকার এই কার্নিভালের দিন। কিন্তু এবার তারা পারেনি মানুষের আওয়াজকে চেপে রাখতে। এই কার্নিভালে ছিলেন চাকরি প্রার্থীরাও। 
এবারের শারদোৎসবে এক নতুন লড়াইয়ের সাক্ষী থাকলো রাজ্যবাসী। সাধারণত এই চারদিন সংমাধ্যমে দেখা যেত কোন মন্ত্রী কার সাথে ডাক বাজাচ্ছে, কার পুজোয় কতো ভির, কে বছরের একটা দিন কাঁদছে। প্রাইম টাইম জুড়ে থাকত এই সব। কিন্তু না এবার তার বদলে গেলো, প্রাইম টাইম জুড়ে থাকল ‘দ্রোহকাল’।

দেখুন ভিডিও

Comments :0

Login to leave a comment