আসমুদ্রহিমাচল। ১৪০ কোটির ভারতবর্ষ। একইসঙ্গে নাচছে। গাইছে। আনন্দে উদ্বেলিত সবাই। টানটান ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে ৭০ রানে উড়িয়ে বিশ্বজয় থেকে এক ম্যাচ দূরে ভারত। সামনেই যেই আসুক দক্ষিণ আফ্রিকা বা অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালের প্রতিপক্ষ নিয়ে কেউই ভাবছেন না, এখন থেকেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রহর গুনছে কোহিমা থেকে কচ্ছ। কন্যাকুমারি থেকে কলকাতা।
একযুগ আগে এই ওয়াংখেড়তে বিশ্বজয়ের স্বাদ পেয়েছিল ভারত। এবার সেখানেই তৃতীয় বিশ্বজয়ের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখল। জেতার আগে থেকেই চারিদিকে সদর্পে উড়ল জাতীয় পতাকা। বিরাট, রোহিত, সামিদের নামে উঠল জয়ধ্বনি। উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। রোহিতের বিস্ফোরক ইনিংস। বিরাটের শতক। সেমিফাইনালের মতো বড় ম্যাচে মহম্মদ সামির সেরার সেরা স্পেল না থাকলে এই জয় সম্ভব ছিল না। তারপরও রোহিতরা নির্লিপ্ত থাকলেন। বাড়তি কোনও উচ্ছ্বাস নয়, সাধারণ একটি ম্যাচ জেতার পর যেটুকু উচ্ছ্বাস দেখানোর প্রয়োজন, সেটুকুই করলেন, ব্যস! কারণ এখনও দিল্লি খুব দূর না হলে বেশদূর।
ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পরই মুম্বাইয়ের আকাশে বাজির ফোয়ারা। সমুদ্রের পাড়ে ভিড় করেছিল অসংখ্য মানুষ, যারা মাঠে ঢুকতে না পেরে ওখানেই বসে খেলা দেখছিলেন, তাঁরা হলেন বাঁধনহারা। প্রতিটি মুহূর্তকে আঁচিয়ে নিলেন। একে অপরকে আলিঙ্গন করা শুরু করে দিলেন। গলার শিরা ফুলিয়ে বলতে থাকলেন, ‘বিশ্বকাপ না জিতে থামবে না ভারত’। এদিনের তো অপেক্ষায় তো ছিল পুরো দেশ। একটানা দশবছর নকআউটে ম্যাচে বারেবারে ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে ফিরে আসছিল ভারত। নিউজিল্যান্ডের দু’বার হার। ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়। এদিনই সব যেন সুদে আসলে মিটিয়ে দিল রোহিত শর্মার ভারত। ক্ষতে পড়ল প্রলেপ। আর মাত্র একটা ম্যাচ। জিততে পারলেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। তিনদিন আগে দীপাবলি উৎসব পালন করেছেন মুম্বাইয়ের মানুষ। বুধবার ভারতের বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার আনন্দে সারা জাগবে মুম্বাই। মেরিন ড্রাইভের চত্ত্বরে উৎসবের মহল। ভারতের টিমবাস হোটেল যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন তাঁরা। বাস স্টেডিয়াম থেকে বেরোতেই পিছনে পাগলের মতো ছুটলেন। টিম হোটেলের বাইরে গিয়ে জমল ভিড়। বিরাটরা অভিবাদন জানানোর পরও সমর্থকদের শান্ত করতে পারলেন না। সেমিফাইনাল জিতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সমর্থকদের এই অবস্থা যদি হয়, আমেদাবাদে ফাইনালে জেতার পর কী হতে চলেছে, কল্পনার বাইরে!
এদিন সকালে শোনা যায় পিচ বিতর্কের কথা। দিনের শেষে ভারতীয় দলের পারফরম্যান্সের কাছে সব বিতর্ক ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। তবে দু’দলকে নাকি রাতে জানানো হয়, ব্যবহৃত উইকেটে খেলার কথা (যা আইসিসি নিয়মের বাইরে)। অর্থাৎ ছয় নম্বর উইকেটের বদলে সাত নম্বরে পিচ খেলা হবে। যেখানে এর আগে বিশ্বকাপের দু’টি ম্যাচ হয়েছিল। সাত নম্বর বাইশ গজ পুরোই পাটা। যেখানে বোলারদের জন্যই কিছুই নেই। প্রমাণও মিলল। টসে জয়। প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত রোহিতের। ধুন্ধুমার শুরু ভারতের। ভারতীয় অধিনায়কের সৌজন্যে। রোহিতের ইনিংসটাই যেন গোটা ম্যাচের রিংটোন তৈরি দেয়। নিউজিল্যান্ডের প্রধান বোলার ট্রেন্ট বোল্টকে আক্রমণ করা শুরু, টিম সাউদির স্লোয়ারে ফেরার আগে করে গেলেন ২৯ বলে ৪৭। রোহিতের তৈরি ভিতে বিরাট, শ্রেয়স, গিল, কে এল রাহুলরা মিলে নির্ধারিত ৫০ ওভারে তুলে ফেলল প্রায় চারশোর কাছাকাছি (৩৯৭/৪)। গিলের অপরাজিত ৮০ (তাঁর পেশিতে টান ধরায় ইনিংস চালিয়ে যেতে পারেননি), বিরাটের ঝকঝকে ১১৭, শ্রেয়সের ৭০ বলে ১০৫, শেষদিকে রাহুলের ২০ বলে ৩৯। যিনিই ব্যাট হাতে নেমেছেন, তিনিই মেরেছেন। যাকে বলে ভয়ডরহীন আগ্রাসী ক্রিকেট। সূর্য বাদে প্রত্যেকের স্ট্রাইক রেট একশোর উপরে। ছয় ভারতীয় ব্যাটার মিলে মেরেছেন ৪৯ টি বাউন্ডারি। জেরে সাউদি দিলেন ১০০ রান। বোল্ট দিলেন ৮৬, ফার্গুসন এত মার খেয়েছেন তাঁকে দিয়ে কিউয়ি অধিনায়ক পুরো ওভার বল করালেন না। কিছুটা আঁটোসাঁটো বোলিং স্যান্টনারের (১/৫১)।
ভারত বোর্ডে পাহাড়প্রমাণ রান তোলার পর, প্রেসবক্সে আলোচনা চলছিল ফাইনালে যাচ্ছেই ভারত। যদি না ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপের মতো কিছু ঘটে। সেই ম্যাচেও দুশোর কাছাকাছি তোলার পর, গেইল,স্যামুয়েলসরা দ্রুত ফিরে যান। এরপর হেরে যায় ভারত। সেই স্মৃতি ফিরে আসতে আসতেও এল না। সামির সুবাদে। একাই নিলেন সাতটি উইকেট। ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেমিফাইনালে ৫৭ রানে দিয়ে সাত উইকেট নেওয়ার রেকর্ড কারোর নেই। চলতি বিশ্বকাপে সাত ম্যাচে ২২ টি শিকার সামির। উইকেটশিকারীদের তালিকায় যুগ্মভাবে অ্যাডাম জাম্পার সঙ্গে শীর্ষে। মহম্মদ সিরাজ, জসপ্রীত বুমরাদের খারাপ দিনে, সামির হাত থেকে দুর্ধর্ষ স্পেল না বেরোলে, কেন উইলিয়ামসন, ড্যারিল মিচেল যা শুরু করেছিলেন, ম্যাচ আরও কঠিন হয়ে যেত। এই সামি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইলিয়ামসনের সহজ ক্যাচ ফেলে দেন। খলনায়ক হতে হতে ম্যাচের অন্যতম নায়ক তিনি।
ডেভন কনওয়ে, ছন্দে থাকা রাচিন রবীন্দ্রকে ফেরানোর পর। ৩৯৮ রান তাড়ায় নেমে ৩৯/২ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল, সহজেই ম্যাচ জিতবে ভারত। কিন্তু ড্যারিল মিচেল ও উইলিয়ামসন মিলে ভারতবর্ষের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেন। তাঁরা স্কোরবোর্ড সচল রাখছিলেন নিয়মিত ব্যবধানে বাউন্ডারি মেরে। জুটিতে উঠল ১৭৯। দ্বিতীয় স্পেল ফিরে এসে দু’বলের ব্যবধানে প্রথমে কেন (৬৯), তারপর টম ল্যাথামকে (০) ফিরিয়ে দিয়ে দলের জয়ের পথ নিশ্চিত করেন তিনি। এরপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে শতরান করেন মিচেল। তাঁর সঙ্গে গ্লেন ফিলিপস চেষ্টা করছিলেন ম্যাচ গভীরে নিয়ে যাওয়ার, স্লগ ওভারে বুমরা থামালেন ফিলিপসকে (৪১)। এখান থেকে জয় ছিল সময়ের অপেক্ষা। গ্লেন আউট হওয়ার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপ। শেষ পাঁচ উইকেট পড়ল মাত্র ৩২ রানে। পরিস্থিতি বিচার করলে দুই স্পিনার কুলদীপ যাদব ও জাদেজার স্পেল কিন্তু সমান কার্যকরী। এটাই হল ভারতীয় দল। সারা প্রতিযোগিতায় সম্মিলিত পারফরম্যান্সে একটানা দশ ম্যাচ জিতে ফাইনালে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর— ভারত ৫০ ওভারে ৩৯৭/৪ (বিরাট ১১৭, শ্রেয়স ১০৫, সাউদি ৩/১০০)
নিউজিল্যান্ড – ৪৮.৫ ওভারে ৩২৭ অলআউট (মিচেল ১৩৪, সামি ৭/৫৭)
ম্যাচের সেরা – মহম্মদ সামি
India world cup
বিশ্বজয়ের স্বপ্ন আরো কাছে
×
Comments :0