দেশের বেহাল অর্থনীতির ছবি স্পষ্ট হয়ে গেল সরকারি পরিসংখ্যানেই। কেন্দ্রের পরিসংখ্যান দপ্তরের (এনএসও) প্রকাশিত তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-২৫ আর্থিক বর্ষে এক ধাক্কায় বেশ খানিকটা কমতে চলেছে জিডিপি বৃদ্ধির হার। সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, ২০২৪-২৫ আর্থিক বর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হার হতে চলছে ৬.৪ শতাংশ। এই হার চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থাৎ এক ধাক্কায় ১.৮ শতাংশ কমতে পারে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার। এই আশঙ্কা সত্যি হলে কোভিড পরবর্তী সময়ে সব থেকে কম হবে জিডিপি বৃদ্ধির হার। ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে ওই হার ছিল ৬.৬ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ৭ শতাংশ। গত আর্থিক বর্ষে অবশ্য এই বৃদ্ধির হার বেড়ে গিয়ে ৮.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। ফলে চলতি অর্থবর্ষের সার্বিক বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলেই মনে করা হচ্ছে।
এমন এক পরিস্থিতি যে হতে চলেছে সেই পূর্বাভাস মিলেছিল আগেই। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অনুমান ছিল, জিডিপি বৃদ্ধির হার কমলেও তা ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে থাকবে। এই হার কমতে চলেছে সেই আশঙ্কা আগে জানিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল ৬.৬ শতাংশ। তার চেয়েও জিডিপি বৃদ্ধি কমতে চলেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর।
এই আগাম পরিসংখ্যানের প্রয়োজন পড়ে সাধারণ বাজেট প্রস্তুতির ক্ষেত্রে। যে খসড়া বাজেট আগামী ১ ফেব্রুয়ারি লোকসভায় পেশ করবেন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এর আগেই তিনি যা পরিসংখ্যান হাতে পেলেন তা দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে খুব সুখকর ছবি নয়, তা অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার যতই ‘বিকশিত ভারত’ বলে বাগাড়ম্বর করুক না কেন, বাস্তবে দেশের অর্থনীতির এমনই দশা। এই বেহাল অবস্থা আর গোপন করা যাচ্ছে না, সরকারের নিজস্ব তথ্যেই তা ফুটে বেরিয়ে আসছে।
সরকার নিজেই জানাচ্ছে, উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রের হাল এবার ভাল নয়। এরই সরাসরি প্রভাব পড়েছে আর্থিক বৃদ্ধির উপরে। গত বছর উৎপাদন ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার ৯.৯ শতাংশ ছিল, এবার কমে ৫.৩ শতাংশ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তেমনই পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৫.৮ শতাংশে। যা গত আর্থিক বর্ষে ছিল ৬.৪ শতাংশ। পরিষেবা ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে ব্যবসা, হোটেল, পরিবহণ এবং যোগাযোগ ক্ষেত্র। গত আর্থিক বর্ষে এই হার ছিল ৬.৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উৎপাদন এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখজনক লগ্নি না আসায় বৃদ্ধির হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
একমাত্র উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো কিছুটা হলেও কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার। ২০২৩-২৪ সালে কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪ শতাংশ, চলতি আর্থিক বর্ষে সেই হার বেড়ে ৩.৮ শতাংশ হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধি হলেও শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের বেহাল দশার ফলে সামগ্রিক আর্থিক বৃদ্ধির হার ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুনে জিডিপি ছিল ৬.৭ শতাংশ। এর ফলে অনুমান করা হচ্ছিল দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে এই হার আরও কমতে পারে। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে এই হার নেমে দাঁড়ায় ৫.৪ শতাংশে। এবার সার্বিকভাবে গোটা আর্থিক বর্ষেই জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে ৬.৪ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর।
চলতি বছরের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের যে পরিসংখ্যান হাতে এসেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে প্রাথমিক (প্রাইমারি) এবং অনুসারী (সেকেন্ডারি) ক্ষেত্রের মন্দার জেরেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কয়েকজন অর্থনীতিবিদদের ধারণা, ভারতীয় অর্থনীতি চক্রাকারে মন্দার স্তরে প্রবেশের ফলেই বৃদ্ধির এমন মন্থরতা। আগের তিন ত্রৈমাসিকের মন্দার জেরে সার্বিক আর্থিক বৃদ্ধির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। অর্থনীতিবিদরা অবশ্য এরই সঙ্গে আরও কয়েকটি কারণ ব্যাখ্যা করছেন আর্থিক বৃদ্ধির হার কমার ক্ষেত্রে। এগুলি হল; ১) বিকাশের হার গণনার ভিত্তিতে ত্রুটি, ২) সাধারণ নির্বাচন, ৩) বেসরকারি ক্ষেত্রের কম মূলধনী ব্যয় এবং ৪) মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও কোষাগার ব্যবহারে কঠোর পদক্ষেপ।
অর্থনীতিবিদরা যাই যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করুন না কেন, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই চাপে পড়ে গিয়েছে মোদী সরকার। কয়েক বছর যাবৎ নরেন্দ্র মোদী ২০২৮ সালের মধ্যে ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে পরিণত করবেন বলে বড়াই করে চলেছেন। চলতি আর্থিক বর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হারে এই ব্যাপক পতন তাঁর ‘অতি-কথন’ ধাক্কা খাবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
GDP
আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪ বছরে সবচেয়ে কম হতে চলেছে
×
Comments :0