Lok Sabha Elections 2024

ফকির, সেফটিপিন আর ‘প্রধানদা’

রাজ্য লোকসভা ২০২৪

ক্যাপশন: মানবাজারের বিশরীতে মঙ্গলবার বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতোকে নিয়ে প্রচার। ছবি: শ্যামল মজুমদার


চন্দন দাস ও ভাস্কর দাশগুপ্ত মানবাজার

 

সবাই ডাকে ‘প্রধান’ বলে। তবে এখন তিনি সেই পদে নেই। ছিলেন পঞ্চায়েত প্রধান ভালুবাসার। পাঁচ বছর, ২০০৮ থেকে ২০১৩। এখন 'দামুডি ঢোল পার্টি'-তে কুড়কুড়ি বাজান নরেন কালিন্দী। আদলে ছোট, কুড়কুড়ি সেই বাদ্যযন্ত্র, যা ছাড়া ঢোলের বোলে কাঙ্ক্ষিত মাতন ওঠে না। 
নির্বাচন লোকসভার। সেই আলোচনায় জঙ্গলমহলের একটি ব্লকের একটি পঞ্চায়েতের এক প্রাক্তন প্রধানের গল্পের কী গুরুত্ব? দেশের সরকার তৈরির এই নির্বাচনে একদিকে নিজেকে 'ফকির' হিসাবে তুলে ধরা নরেন্দ্র মোদী। আর একদিকে হাওয়াই চটিতে সেফটিপিন লাগানোর ঘোষণা করে 'সততার প্রতীক' বিশেষণ ফিরে পেতে চাওয়া মমতা ব্যানার্জি। অন্তত মিডিয়ার বড় অংশ এবং তৃণমূল, বিজেপি নেতারা চাইছে এই দুই মেরুর মধ্যে ভোটদাতাদের নজর আটকে রাখতে। 
কিন্তু তৃতীয় মেরু আছে। আছে সাধারণের মাঝে। 'প্রধানদা' তার নমুনা। 
কেন সবাই এই নামে ডাকে? ঢোল পার্টির বাকিদের মাঝে দাঁড়িয়ে নবীন কালিন্দী বলেন, "কেউ প্রধানদা বলে। কেউ প্রধান কাকা বলে। কেউ শুধু প্রধান বলে। ভালোবাসে সক্কলে। আমার তো দোতলা, তিনতলা বাড়ি হয়নি। জমি হয়নি। কারও থেকে দু’টাকা নিইনি।" কিন্তু সেই মানুষই তো হারিয়ে দিলো? মানবাজারের পাথরমোহরায় সিপিআই(এম) কার্যালয়ের মেঝেতে শুয়ে ছিলেন নবীন কালিন্দী। একটু ঘুমিয়েও নিয়েছেন। মুখ, চোখে জল দেওয়ার জন্য উঠতে উঠতে বললেন, "মানুষ সবসময় বুঝতে পারে না। ভুল করে। আমরাও তো করি। করি না? আবার শিক্ষা নিই।"
এই কথা আগে শুনেছি। আর একজনের মুখে। বারবার। দেশের তাবড় নেতা যেখানে কান পেতে থাকতেন, তিনি বক্তা থাকলে, সেই ব্রিগেডে। 
জ্যোতি বসু অক্ষয়। আজও। কুমারী নদীর পাড়ে মানবাজার তা আর একবার জানিয়ে দিলো। 'প্রধানদার' কথার রেশ মিলেছে পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায়। কী সেই রেশ? হেমন্ত মাহাতোর অভিজ্ঞতা হলো, "এখন দেখছেন তো কী হচ্ছে! মোদীর সভায় নিয়ে যেতে ৩০০টাকা করে দিয়েছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে ওদের ভোট কমছে।" কেন বিজেপি’র ভোট কমছে?
উত্তর? রাজেশ সর্দার। 
বনকাটা গ্রামের বাসিন্দা যুবক বিবেকানন্দ রক দেখেছেন। একাধিকবার। বললেন, "আমি পাঁচবার কন্যাকুমারী গেছি। থেকেছি। ওখানে কেউ মানবাজার বলে কোনও জায়গা আছে জানে না। কলকাতা চেনে। কলকাতার ছেলে হিসাবে আমাদের জানে। কলকাতার ছেলেদের খুব দাম। আমি টাইলসের কাজ করতাম। এলাকার কয়েকশো ছেলে ওখানে আছে। বেশি মজুরি। তবে খুব খাটনি। আমার গ্রাম থেকেই প্রায় ২৫জন ওখানে। আমার পাশের গ্রাম তিলাবনি। সেখানে তো গ্রামে ছেলে বলতে কেউ নেই।"
সদ্য বিয়ে করেছে বলে রাজেশ টোটো চালাচ্ছেন। কিন্তু কন্যাকুমারী তাঁকে টানে টাকার জন্য। 
একই ছবি পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের প্রতি গ্রামে। কাজ নেই। 
মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, কাজ দেবেন। শিল্প হবে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে পুরুলিয়ায় শিল্পের উদ্যোগ। গত ১৩ বছরে জেলায় কোনও শিল্প আসেনি। দেদার চুরি সবক্ষেত্রেই। 
এই তৃণমূলকে 'টাইট' দেবে বিজেপি, এমন ভেবেছিলেন অনেকে। সিপিআই (এম) নেতা প্রদীপ চৌধুরির কথায়, "সেই টাইট তো বিজেপি দেবে না, মানুষ বুঝতে পারছেন। আমরা যখন দু’দলের বোঝাপড়ার কথা বলেছি আগে, অনেকেই বুঝতে পারেননি। বিশ্বাস করতে সময় লেগেছে। তাছাড়া...। "
তাছাড়া কী? 
"মোদী তো বলার মতো কিছু করেননি। কাজ দেবেন তো তিনিও বলেছিলেন। ওষুধের দাম বিরাট। সব জিনিসের দাম বেড়েছে। রামনবমী তো এখানেও হয়। আমাদের পুরুলিয়ায় দেখবেন অনেকেই রামনবমী করে বাড়িতে। তার মানে তো গোলমাল করা নয়? রামমন্দির বানানো তো কোনও সরকারের একমাত্র কাজ হতে পারে না। তার জন্য তাঁকে ভোট দিতে হবে, এর কোনও মানে নেই।"
যিনি এই কথা বললেন, তাঁর বাড়ির ছাদে এখনও হনুমানের মুখ আঁকা তিন কোণা গেরুয়া ঝান্ডা উড়ছে। রামনবমীর চিহ্ন।
এই সব বিষয় পুরুলিয়ার বিষয়। আসলে দেশের বিষয়। সে সব নিয়েই প্রচারে সিপিআই (এম) এবং কংগ্রেস কর্মীরা। পুরুলিয়ার বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতো। 
জেলার বিভিন্ন সমস্যা উঠে এসেছে তাঁদের প্রচারে। যেমন, বলরামপুরের বিপন্ন লাক্ষা শিল্প। ব্রিটিশ আমলে এখানে লাক্ষা শিল্পের প্রসার। লাক্ষা কুঠিগুলিতে কয়েক হাজার মানুষ কাজ করতেন। এখানকার লাক্ষাজাত সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হতো। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে বলরামপুরের লাক্ষা ক্লাস্টারের উদ্যোগ। গত এক বছর সে লাক্ষা ক্লাসটার বন্ধ। কারণ ইলেকট্রিক বিল বকেয়া থাকার জন্য বিদ্যুৎ দপ্তর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। তারপর থেকে উদাসীন প্রশাসন। বলরামপুরের লাক্ষা শিল্প ধুঁকছে।
অথচ এই বলরামপুরে এক সময় অনুন্নয়নের অজুহাতে মাওবাদী-তৃণমূলীরা সিপিআই(এম) কর্মী-সমর্থকদের নির্বিচারে খুন করেছিল।
পুরুলিয়া বিধানসভা বিজেপি’র দখলে। পৌরসভা তৃণমূলের দখলে। শহরাঞ্চলে পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট।  মুখ্যমন্ত্রী যতবার জেলা সফরে আসেন ততবার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে যান জাইকা প্রকল্পের কথা। ১৩ বছরে সে জাইকা প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। ঘরে ঘরে পানীয় জলের সংযোগ দেওয়ার নাম করে প্রায় ২-৩ বছর আগে নাগরিকদের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে নিয়েও আজ  অবধি পানীয় জলের সংযোগ দিতে পারেনি পৌরসভা। পুরুলিয়ার সাহেব বাঁধ ছিল জেলার গর্ব। প্রস্তাবিত সে জাতীয় সরোবর আজ অসুস্থ। সেখানে কচুরিপানার চাষ করা হচ্ছে। সাহেব বাঁধ হচ্ছে শাসকদলের রেকারিং। প্রস্তাবিত সে জাতীয় সরোবরের ফাইল নাকি পৌরসভায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
জয়পুর বিধানসভার বিধায়ক বিজেপি’র। এখনো গ্রামীণ এলাকায় অনুন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট। রাস্তাঘাট নেই বা একেবারে খারাপ। গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে চিকিৎসক নেই, পর্যাপ্ত ওষুধও পাওয়া যায় না। বহু স্কুলে শিক্ষক নেই। কাশীপুর এলাকা থেকে কয়েক হাজার যুবক কাজের সন্ধানে দক্ষিণ ভারত অভিমুখী। লকডাউনের সময় তারা যখন তৃণমূলের বিধায়ক এবং বিজেপি’র সাংসদকে ফোন করে যোগাযোগ করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার আরজি জানিয়েছিল। তখন তাদের উক্তি ছিল ওই সমস্ত অসহায় যুবকেরা তো তাদের পার্টির ভোটার নয়। কিন্তু সেই সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া। ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসন ঘটিয়ে এই কাশীপুরে বাসুদেব আচারিয়াকে রাস্তায় ফেলে মারা হয়েছিল। 
প্রতিরোধ দেখেছে রাজ্য পুরুলিয়াতে। দেখিয়েছে পাড়ার পাহাড়িগোড়া। তবে জেলার কোনও সমস্যা নিয়েই যেমন বিজেপি মুখর হয়নি, এখানেও তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। এখানে পাহাড় থেকে কেটে নিয়ে বিক্রি করার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল তৃণমূলের মদতে। এলাকার মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। অবশেষে আদালতের নির্দেশে বন্ধ হয়েছে সে পাহাড় কাটা।

Comments :0

Login to leave a comment