Ram BJP TMC

‘সনাতনী হিন্দু’ সেজে সঙ্ঘের মিছিলে তৃণমূল

রাজ্য

দুপুরে তখন শহর কলকাতায় সংহতি মিছিলে হাঁটছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, অভিষেক ব্যানার্জি। ঠিক সেই সময়েই উত্তরবঙ্গে মালদহের হরিশচন্দ্রপুরে ‘রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে’ শাসক তৃণমূল ও বিজেপি’র যৌথ উদ্যোগে ধর্মীয় শোভাযাত্রায় একসঙ্গে পথ হাঁটলেন বিজেপি’র মণ্ডল সভাপতি, পঞ্চায়েত সসদ্যদের সঙ্গেই তৃণমূলের হরিশচন্দ্রপুরের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সাগর দাস, বাবলু দাসরা। 
শুধু তাই নয় প্রকাশ্যেই তৃণমূল নেতাদের দাবি, ‘রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসাবে নয়, সনাতনী হিন্দু হিসাবেই তাঁরা এদিনের মিছিল করেছেন।’ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা ভায়া তৃণমূল বিজেপিতে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারী বারেবারেই এই সনাতনী শব্দটি ব্যবহার করেন সমস্ত বক্তৃতায়। হরিশ্চন্দ্রপুরের তৃণমূল নেতারা সেই সনাতনী হিসাবেই নিজেদের দাবি করে গেরুয়া ঝান্ডা হাতে, তিলক পরে, রামের ছবি নিয়ে মিছিল সারলেন।
ধর্মীয় শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা ছিল শাসক তৃণমূলই। হরিশ্চন্দ্রপুর কিরণবালা বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে রামের মূর্তি পুজো দিয়ে দলীয় পতাকা ছাড়া তৃণমূলের মিছিল শুরু হয় দুপুরে। সেই সময়তেই আবার হরিশ্চন্দ্রপুরের গোরগেড়ি হাটের সামনে দিয়ে বিজেপি’র শোভাযাত্রা শুরু হওয়ার কথা। প্রশাসন জানায় দুটো আলাদা মিছিল করা যাবে না, একসঙ্গেই করুন। এরপরেই তৃণমূল আর বিজেপি’র এই ধর্মীয় মিছিল একসঙ্গেই মিলে যায়। হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লক পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের সদস্য বাবলু কর্মকার বলেন, শুধু হরিশ্চন্দ্রপুর নয় সারা দেশ জুড়ে সনাতন হিন্দুরা মেতে উঠেছে উৎসবের আনন্দে। আমি একজন সনাতনী হিন্দু হিসাবে এসেছি। সকলে মিলে উৎসবের আয়োজন করেছি। পাশাপাশি বিজেপি’র জেলা কমিটির সদস্য রূপেশ আগরওয়াল বলেন, যেসব হিন্দু আজ শোভাযাত্রায় আসবেন না তাঁদের ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন। শুধু হরিশ্চন্দ্রপুরে নয় মালদহের একাধিক জায়গায় দেখা গেছে এমন ছবি। মানিকচকে বিজেপি’র পঞ্চায়েতের পাশাপাশি তৃণমূলের দখলে থাকা পঞ্চায়েতেও সাড়ম্বরে সকাল থেকে চলল যজ্ঞ, প্রদীপ জ্বালানো, ভোগ বিতরণের কর্মসূচি। 
‘সনাতনী’ তৃণমূল আর ‘সনাতনী’ সঙ্ঘ কার্যত সোমবার মিলেমিশে গেল উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গ রাজ্যের একাধিক জায়গায়। নরম হিন্দুত্ব নয়, একেবারে হিন্দুত্ববাদীদের সুরেই স্রেফ ভোট বাক্সের সমীকরণে তৃণমূলও এদিন নেমে পড়ল একাধিক জায়গায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার উৎসব আয়োজনে। কার্যত সঙ্ঘের শাখা সংগঠনের ভূমিকাই একাধিক জায়গায় পালন করল মমতা ব্যানার্জির দল। কলকাতায় সংহতি মিছিল আর জেলায় জেলায় তৃণমূলের সনাতনী সেজে ধর্মীয় শোভাযাত্রা বের করা আসলেই একই রাজনৈতিক কৌশল— ধর্মকে টেনে আনো ব্যালট বক্সে, মেরুকরণের রাজনীতিকে আরও তীব্র করো। 
একই চিত্র উত্তর দিনাজপুরেও। তৃণমূলের ভাড়া করা টোটো, বিজেপি’র ঝান্ডা রামের নামে মিলেমিশে একাকার। তৃণমূলী বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী গ্রামে গিয়ে বলে এসেছেন ঘরে যার যা ঝান্ডা আছে নিয়ে যেতে। বিধানসভা ভোটের আগে দেদার বিলিয়েছে জয় শ্রীরাম লেখা বিজেপি’র ঝান্ডা। রামভক্তির ঝান্ডা হাতে তৃণমূল বিজেপি একসঙ্গে। রায়গঞ্জের বিধায়কের বাড়িতেও রামের ভজন চলল। রায়গঞ্জে তৃণমূলের মিছিলেও লক্ষ করা গেল তৃণমূলের ভাড়া করা টোটোতে গেরুয়া, রামের ছবি দেওয়া পতাকা। রামমন্দিরের উৎসবে মিলে মিশে গিয়েছে বিজেপি-তৃণমূল। গ্রামে গ্রামে এমন ছবি। 
আবার অযোধ্যায় ‘রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার’ সময়েই নিজের বাড়িতে রাম-ভজন করলেন শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব। সোমবার সকাল সকাল হারমোনিয়াম সহযোগে তিনি বসে পড়েন রামভজনায়। পরে বলেন, আজকের দিনে মহাত্মা গান্ধীর রামধনু গান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গান্ধীজীর এই ভজনে রাম ও সীতাকে সম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিলিগুড়িতে তৃণমূলের সংহতি মিছিলও হয়েছে। আবার বিজেপি’র মন্দির পরিষ্কারের কর্মসূচিতেও কোথাও ভিড়ে যেতে দেখা গেছে তৃণমূলীদের। 
দক্ষিণবঙ্গে খড়্গপুরেও একই চিত্র। বিজেপি’র সাজানো রামলীলা যজ্ঞে নৈবেদ্য নিয়ে হাজির তৃণমূল। খড়্গপুর শহরের গোলবাজারে রয়েছে পুরানো দিনের একটি রামমন্দির। সেই মন্দিরে ঘটা করে যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন বিজেপি সাংসদ দিলীপ ঘোষ। সেই যজ্ঞে নৈবেদ্য নিয়ে শামিল হলেন তৃণমূল নেতা সোনি সিং সহ একাধিক দলীয় কর্মী। তৃণমূল নেতা সোনু সিং হলেন খড়্গপুর শহর কমিটির যুব তৃণমূলের সভাপতি। তিনি  তার অনুগামীদের নিয়ে দিলীপ ঘোষের যজ্ঞে শামিল হন এদিন সকালে।
মেদিনীপুর শহরের কলেজ মোড়, জেলা পরিষদের গেটের মুখেও রামের ছবির পতাকার সাথে তৃণমূলের পতাকা মিলেমিশে একাকার হয়েছে। মেদিনীপুর শহরে অনেক যুব তৃণমূল নেতার কপালেও গেরিয়া তিলক সহ উত্তরীয় বেশে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতে। যেখানে যেখানে তাঁবু খাটিয়ে রামের ছবি সহ টিভি শো চলছে তার সীমানায়ও তৃণমূলের পতাকা মিলেমিশে একাকার।
দিনভর সংহতি মিছিল নিয়ে তৃণমূল বিজেপি’র হাইটেক প্রচারে জনমানসে উন্মাদনা ছড়ানোর আড়ালে মেরুকরণের রাজনীতির তীব্র করার প্রতিযোগিতা চলল। বিজেপি, আরএসএস’এর নানা শাখা সংগঠন গেরুয়া পতাকায় রামের ছবি দিয়ে যেখানে তাঁবু খাটিয়ে টিভি সহকারে হইহুল্লোড় করেছে সেখানেও হাজির তৃণমূল। শহর ও শহরতলিতে এমন দৃশ্য দেখা গেলে গ্রামগঞ্জ ছিল নিষ্প্রভ। তবে সংখ্যালঘু এলাকাগুলিকে কেন্দ্র করে জেলার গড়বেতা কেশপুর সহ জেলা শহর মেদিনীপুর, খড়্গপুর শহর সহ অন্যত্রও সংহতি মিছিলের নাম করে তৃণমূল কংগ্রেসই রাম মন্দিরের প্রচার করে দেয়।
শাসক তৃণমূলের দ্বিচারিতার রাজনীতি, আরএসএস সম্পর্কে নীরবতা রাজ্য শুধু সঙ্ঘের শাখা বাড়িয়েছে তা নয় হিন্দুত্ববাদী আস্ফালনের জমিকেও শক্ত করছে। মেরুকরণের রাজনীতিই যে লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যেও শাসক তৃণমূল ও বিজেপি’র নির্বাচনী কৌশল এদিনের আয়োজনেই তা স্পষ্ট।

Comments :0

Login to leave a comment