নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ২ নভেম্বর—আরএসএস’র পথেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নিপীড়নের ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় আনতে চাইছেন মমতা ব্যানার্জি!
সোমবার রাজ্য বিধানসভায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে মুখ খুলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়টিকে রাষ্ট্রসঙ্ঘে নিয়ে যাওয়া উচিত। যাতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফ থেকে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো যায়।’’ মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা অধিবেশনে করা মন্তব্যকে সঙ্গেই সঙ্গেই লুফে নিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এদিন পেট্রাপোল সীমান্তে দলীয় সভায় বিরোধী দলনেতা বলেছেন, ‘‘আমি তো গত দু’দিন আগেই বলেছিলাম, রাষ্ট্রসঙ্ঘের উচিত বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) আজ সেটা বিধানসভায় বলেছেন। এখন তো লোকসভার অধিবেশন চলছে। তৃণমূল দলের সাংসদদের উচিত মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে বিষয়টি নিয়ে লোকসভায় আলোচনা করা।’’
ঘটনা হলো, গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’র সাধারণ সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলীকে আন্তর্জাতিক স্তরে আনার কথা বলেছিলেন। বিবৃতিতে আরএসএস জানিয়েছিল, ‘‘আরএসএস চায়, কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের হিন্দু সহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে যতদূর সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। একইসঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তুলে ধরার জন্য ভারত সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।’’ গত শনিবার আরএসএস সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশের ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় আনার পক্ষে সওয়াল করা হয়। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দু’দিনের মধ্যেই মমতা ব্যানার্জি আরএসএস’র পক্ষে রাজ্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে একই আওয়াজ তুললেন। শুধু তাই নয়, আরও একধাপ এগিয়ে সরাসরি মোদী সরকারকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে বাংলাদেশ নিয়ে হস্তক্ষেপের দাবি করে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর অনুরোধ করে বসলেন।
বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। মমতা ব্যানার্জির মন্তব্য প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম জানান, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তা আমাদের দেশের গৃহীত বিদেশনীতির পরিপন্থী। আমরা সবসময়ই আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতেই মেটাতে চাই। অতীতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাবতীয় ইস্যু, সমস্যা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেই সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছে। এখন দিল্লির শাসকদল ও মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশের ঘটনাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে চাইছে। কোনও স্বাধীন দেশ, স্বাধীনচেতা মানুষের ভাবনার বিরুদ্ধে এই প্রস্তাব।’’
মুখ্যমন্ত্রীর এদিনের মন্তব্য জানার পর গণশক্তি’র তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল আরএসএস’র পূর্বাঞ্চলের প্রচারপ্রমুখ বিপ্লব রায়ের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘আমরা ভারত সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি। কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্যই এটা আন্তর্জাতিক স্তরে মীমাংসা করার ব্যবস্থা করা উচিত। মমতা ব্যানার্জি হাওয়াটা ভালো বোঝেন। তিনি হয়তো বুঝেছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিষয়টি হতে পারে। সেইজন্য তিনি এটা বলে থাকতে পারেন।’’
গত জুলাই মাসের পর থেকেই বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই সংখ্যালঘু, বিশেষত হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা সামনে এসেছে। তারপর থেকেই গোটা দেশ সহ এরাজ্যে রাজনৈতিক ঘটনাক্রমকে ধর্মীয় মোড়ক দিয়ে আসরে নেমেছে সঙ্ঘ পরিবার। এদিন সেই সূত্রেই বিধানসভার অধিবেশনে মুখ খোলেন মমতা ব্যানার্জি। আরএসএস’র পথ ধরে বাংলাদেশের ঘটনাকে আন্তর্জাতিক ইস্যু করার পক্ষে সওয়াল করেন।
এদিন তাৎপর্যপূর্ণভাবে মমতা ব্যানার্জি আরও একটি মন্তব্যেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে এইরকম অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের লোকেদের ফিরিয়ে আনতে চাই। তারজন্য রাজ্য সরকার ব্যবস্থা করবে। থাকার কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু কোনও ভারতীয়র ওপর অত্যাচার হোক এটা আমরা চাই না।’’ বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কোনও ভারতীয় নাগরিকের ওপর নির্বিচারে হামলার ঘটনার খবর নেই। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা সেদেশেরই নাগরিক। তাঁদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তাঁরা নিজেরাও পথে নেমেছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এদিন যেভাবে ‘আমাদের লোক’ বলে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছেন। রাজনৈতিক মহলের মত, আসলে বিজেপি বাংলাদেশ ইস্যুতে এরাজ্যে ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে বিভাজনের রাজনীতি করতে চাইছে। সেই কায়দাতেই মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশের হিন্দুকে আমাদের লোক বলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলেন।
সিপিআই(এম)র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এদিন স্পষ্ট ভাষায় আরও একবার জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত। আমরা বাংলাদেশের স্থায়ীত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে রক্ষা করা বড় কাজ। কিন্তু তদারকি সরকারের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, নির্বাচিত সরকার গঠনে কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারেনি। বরং সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপাসনাস্থল, বাসস্থান, ব্যবসাকেন্দ্র থেকে ব্যাক্তি জীবন চরমভাবে আক্রান্ত। আমরা এর তীব্র নিন্দা করেছি। এমনকি রাজনৈতিক বিরোধীতার নামে খুন, মিথ্যা মামলা বাড়ছে। আমরা চাই বাংলাদেশের মানুষের সুরক্ষা সেখানকার সরকারকেই নিতে হবে।’’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটকে ধর্মীয় আমাদের দেশে ও রাজ্যে বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আরএসএস ও মমতা ব্যানার্জির দলের ব্যবহার করার তীব্র নিন্দা করেছে সিপিআই(এম)।
Comments :0