তারক রাহা
নিখোঁজ নদীয়ার এক পরিযায়ী শ্রমিক।
তাঁর নাম বিদ্যুৎ বিশ্বাস (৩৫)। তাঁকে খুঁজতে জমি বন্ধক দিতে হয়েছে পরিবারকে। বিক্রি হয়ে গিয়েছে গোরু। তাঁর বৃদ্ধ বাবাকে চাষের কাজ করে টানতে হচ্ছে সংসার। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে বহাল তবিয়তে। পরিবার এই অভিযোগ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে নবান্নে, জেলাশাসককেও। তবে কাজের কাজ হয়নি।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে পেটের টানের সংসারে আর্থিক অনটন ঘোচাতে কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণগঞ্জ থানা এলাকার টেংরা গ্রামের গোপাল প্রামাণিকের প্রলোভনে পা দিয়ে বেঙ্গালুরুতে পৌঁছে যান নদীয়ার পরিযায়ী শ্রমিক বিদ্যুৎ বিশ্বাস। যাবেই না কেন। অনিশ্চিত জীবিকার হাতছানি নিয়ে চলা শ্রমিক পেয়েছিলেন প্রতিশ্রতি, সংসারে অভাব অনটন না থাকার। তাই স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে চলে যান বেঙ্গালুরুতে।
গোপাল প্রামাণিকের ফোন থেকে সপ্তাহে একদিন বাড়িতে তাঁর স্ত্রী সঙ্গে কথা বলতেন, টাকাও পাঠাতেন। বেশ কিছু দিন সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। এক বছর পর, চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারি থেকে, বিদ্যুৎ বিশ্বাস বাড়িতে ফোন করা বন্ধ করে দেন। পরিবারের তরফে গোপালকে ফোন করা একাধিকবার, কিন্তু গোপাল নানান অছিলায় পারিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়নি বলে অভিযোগ। তারপর থেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন পরিবারের লোকজন। এক প্রকার বাধ্য হয়ে টেংরার গোপাল প্রামাণিকের বাড়িতে যান বিদ্যুৎ বিশ্বাসের স্ত্রী অনিমা বিশ্বাস। বাড়িতে ছিলের গোপালের স্ত্রী সান্ত্বনা প্রামাণিক। তিনি বলেন যে বিদ্যুৎকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ৫০ হাজার টাকা দিলে তাঁকে খুঁজে দেওয়া হবে।
সান্ত্বনা প্রামাণিক জানাচ্ছেন, এমন বক্তব্য শুনে থানায় যাওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে তাঁদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় কৃষ্ণগঞ্জ থানার পুলিশ।
থানা ফিরিয়ে দিলেও হাল ছাড়েনি পরিবার। কৃষ্ণনগর জেলার মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দরখাস্ত করেন স্ত্রী। ম্যাজিস্ট্রেট কৃষ্ণগঞ্জ থানাকে এফআইআর নেওয়ার নির্দেশ দেন। গত ১৮ এপ্রিল থানা এফআইআর নেয়। পুলিশই গোপাল প্রামাণিককে বলে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে বিদ্যুৎ বিশ্বাসকে খুঁজে আনতে। পরিবারের অভিযোগ, সঙ্গে যাবেন বলে তাঁরা টিকিট কেটে স্টেশনে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু আসেননি গোপাল প্রামাণিক। ফের পুলিশে অভিযোগ জানানো হয়। অভিযোগ, থানা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার উপায় না পেয়ে বেঙ্গালুরুতে গিয়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে। বিদ্যুৎ বিশ্বাস যে এলাকায় কাজ করতেন সেখানকার থানাকে ঘটনার তদন্ত করার নির্দেশ দেন কমিশনার। জায়গাটি বেঙ্গালুরুর গোবিন্দপুরা থানার নাগভারা এলাকা।
কিন্তু অভিযোগ, সেই থানার আধিকারিকরা দিনের পর দিন পরিবারকে থানায় বসিয়ে রেখেছে।
বিদ্যুতের পরিবার দু’জন লোক পাঠায় বেঙ্গালুরুতে। তাদের পাঠানোর জন্য খরচ, রোজের পয়সা মিলে খরচ হয় মোটা টাকা। পরিযায়ী শ্রমিকের কার্ড নেই, ফলে কার্যত তাড়িয়ে দেয় স্থানীয় থানা। তার জন্য উকিল ধরতে হয়। উকিল ১৫ হাজার টাকা নেন। উকিল চাপ দিলে থানা খুঁজতে শুরু করে। সেই সময়ে গোপাল প্রামাণিক বেঙ্গালুরু থেকে পালিয়ে যায়। গোপাল ফিরে আসে এলাকায়। কৃষ্ণগঞ্জ থানায় তা জানানো হয়। থানা বলে, বেঙ্গালুরুতে হারিয়েছে আমরা অভিযোগ নেব কেন?
এমনই অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ভারতের শহরগুলিতে বেঁচে আছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। তাঁদের বাসস্থান ও পরিবার এক রাজ্যে, আর অন্যদিকে পেটের টানে, পরিবারকে ভালো রাখার তাগিদে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাঁদের কাটাতে হচ্ছে অন্য রাজ্যে।
এ রাজ্যে নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠছে না। ২০১৪ সালে কেন্দ্রের মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছিলেন বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রতি দিয়ে। রাজ্যে তৃণমূল আর কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের মেয়াদে বেকারি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলস্বরূপ রাজ্যের বহু মানুষ সংসার প্রতিপালন করতে ভিনরাজ্যে, দেশের বাইরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসোবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
গত জুলাই মাসে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা সংক্রান্ত এক মামলার শুনানিতে দেশের শীর্ষ আদালত রাজ্য সরকারগুলিকে মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘‘আমাদের দেশে জনগণের দুটি অংশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক কৃষক, দুই পরিযায়ী শ্রমিক। দেশের ভিত তৈরিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের গুরুত্বও অপরিসীম। তাঁদের অধিকার কোনোভাবে অস্বীকার করা চলবে না’’।
রেশন, নগদ অর্থ সহ কেন্দ্রের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির সুযোগ সুবিধা তাঁদের হাতে পৌঁছে দিতে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।
গ্রামের মানুষের অভিযোগ নদীয়ার কৃষ্ণনগর, ভামপুর থানা অঞ্চল থেকে বহু বেকার যুবককে গোপাল প্রামাণিকের মতো এজেন্টরা বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ে যায়। কেবল বেঙ্গালুরুই নয়, দক্ষিণ ভারতের অন্য শহরেও নিয়ে যায়। তাঁদের কারও কারও খোঁজ পাওয়া যায় না কিছুদিন পর থেকেই।
স্থানীয়রা ক্ষোভের সুরে বলেন, এই বিষয়ে কেউ কিছু জানতেই পারে না। রাজ্যে নতুন শিল্প কলকারখানা নেই। যা আছে তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়রা জানাচ্ছেন, গোপাল প্রামাণিক থানায় বলেছিল যে বিনয় নামে এক ঠিকাদারের সঙ্গে বিদ্যুৎ কাজ করত। বিনয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সহায়তা করেনি। বরং গোপাল এবং বিনয় থানায় গিয়ে জানায় যে বিদ্যুৎ কোথায় দু’জনের কেউ জানে না। তারপর পুলিশও সরে যায়। পুলিশকে আর কোনও ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
তৃণমূল এবং বিজেপি’র শাসনে বেকারি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অন্য রাজ্যে বা অন্য দেশে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার চক্র সক্রিয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই চক্রে পরোক্ষ মদত রয়েছে প্রশাসনের।
বিদ্যুৎ বিশ্বাসের অসহায় পরিবার আজও অপেক্ষায় দিন গুনছেন করে বাড়ি ফিরবেন তাদের প্রিয় মানুষটি। পরিবারে রয়েছেন বৃদ্ধ মা, বাবা, ভাই, বৌ, মেয়ের বয়স ১৪। তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘‘লেখাপড়া জানে না, রাস্তার কাজটাজ করে, ফোন ব্যবহার করতেও জানেন না। মাঠে জনমজুরি করেন। গোপাল প্রামাণিক বলেছিল তার সঙ্গে গেলে পয়সা বেশি পাবে। ওই সাদাসিধে মানুষটি পরিবারিক অনটন দূর করতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই গোপাল প্রামাণিকের প্রলোভনে পা দিয়েছেন।
শিল্প তাড়িয়ে রাজ্যের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। বেকারদের চাকরি দিতে পারেনি আরআরএস পরিচালিত বিজেপি’র নরেন্দ্র মোদী সরকার। পেটের টানে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ যুবক দেশের বিভিন্নপ্রান্তে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো যাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদী সরকার ক্ষমতায় এল তাদের মধ্যে রয়েছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক। তাদের খবরও রাখে না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ক্ষতিপূরণের দায় এড়াতে ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গয়ার সংসদেই জানিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু কেন্দ্রের কাছে কোনও তথ্যই নেই। লকডাউনের কারণে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে ফেরার সময় পথ দুর্ঘটনায় অন্তত ১৯৮ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। রীতিমতো হিসাব কষে তাঁরা দেখিয়েছে, ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে’র মধ্যে ১৪৬১টি পথ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গিয়েছেন ৭৫০ জন। তার মধ্যে ১৯৮ জন পরিযায়ী শ্রমিক।
সরকারের কাছে হিসাব নেই। হিসেব আছে আইএলও এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের যৌথ সমীক্ষায়। আগস্টের মাঝামাঝি প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে, কোভিডের কারণে ভারত শুধু ৪১ লক্ষ যুবকই কাজ হারিয়েছেন। আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক। এপ্রিলে, তাদের প্রতিবেদনের হিসাবে দেশজোড়া লকডাউন প্রভাব ফেলেছে ৪ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন-জীবিকায়। সিএমআইই’র হিসাবে এপ্রিল-আগস্টে ছাঁটাই হয়েছেন ২ কোটি ১০ লক্ষ চাকরিজীবী মানুষ।
Comments :0