ভারতে প্রতিদিন ১৫৪ জনেরও বেশি কৃষক, খেতমজুর বা দিনমজুর আত্মহত্যা করছেন। মানে, ২৪ ঘণ্টার গড় হিসেব নিলে প্রতি ঘন্টায় এদেশে অন্তত ৭জন কৃষক বা মজদুর আত্মহত্যার মতো নির্মম পথ বেছে নিচ্ছেন। কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাডু এবং মধ্য প্রদেশেই। আত্মঘাতীদের তালিকায় বিপুল সংখ্যায় রয়েছেন এদেশের দিনমজুররা, যাঁদের স্থায়ী কোন কাজ নেই, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা চালান।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)’র সর্বশেষ রিপোর্টে সরকারিভাবে এই তথ্য জানানো হয়েছে। ২০২২ সালের সমীক্ষার ভিত্তিতে গত শুক্রবার এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। অ-সরকারি বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রের মোদী সরকারের কর্পোরেটমুখী নয়া-উদার অর্থনৈতিক নীতির কারণে এদেশে কৃষিক্ষেত্র সহ সামগ্রিক জীবন-জীবিকায় গভীর সঙ্কটের চেহারাই স্পষ্ট হয়েছে এনসিআরবি রিপোর্টে।
রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত বছর সারা দেশে মোট ১,৭০,৯২৪ টি আত্মহত্যার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৬.৬ শতাংশই কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে। পাশাপাশি, দিনমজুরদের আত্মহত্যার হার ২৬.৪ শতাংশ। রিপোর্ট জানিয়েছে, ২০২২ সালে কৃষিক্ষেত্রে জড়িত ১১,২৯০ জনেরও বেশি মানুষ নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে ৫২০৭ জন কৃষক এবং ৬০৮৩ জন খেতমজুর। আত্মঘাতী ৫২০৭ জন কৃষকের মধ্যে ৪৯৯৯ জন পুরুষ। মহিলা ২০৮ জন। একইসঙ্গে গত বছর আত্মহত্যা করেছেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত অন্তত ৪১,৪৩৩ মানুষ।
তবে এনসিআরবি রিপোর্টে উল্লেখিত কৃষক ও দিনমজুরদের আত্মহত্যার এই পরিসংখ্যান যথেষ্টই অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। কারণ প্রথমত সরকারিভাবে নথিভুক্ত ঘটনাগুলিই রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর বাইরেও আত্মহত্যার অসংখ্য ঘটনা ঘটে। সর্বোপরি কৃষি সঙ্কটের আসল চেহারা আড়াল করতে বহু ক্ষেত্রেই ‘অসুস্থতা’, ‘পারিবারিক বিবাদ’ ইত্যাদিকে কৃষক ও খেতমজুরদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখানো হয়। সরকারি নীতির বেহাল দশা লুকোতে কৃষক-খেতমজুরদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলি চেপে যাওয়ার প্রবণতা থাকে বিভিন্ন রাজ্যের সরকারের।
যেমন এবারের রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওডিশা, উত্তরাখন্ড, গোয়া, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, চন্ডীগড়, দিল্লি, লাক্ষাদ্বীপ, পুদুচেরির মতো রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কৃষক ও খেতমজুরের আত্মহত্যার সংখ্যা ‘শূন্য’ দেখানো হয়েছে। যেমন, গত ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গে দু’শোরও বেশি কৃষক বা খেতমজুর আত্মঘাতী হয়েছেন। সেরাজ্যের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এসব আত্মহত্যার রিপোর্ট সবিস্তারে প্রকাশিত হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি ঘটনাও কবুল করেনি; এনসিআরবি রিপোর্টে প্রকাশের জন্য কেন্দ্রের কাছে তথ্যও পাঠায়নি। ফলে প্রতি বছরই পশ্চিমবঙ্গে কৃষক বা খেতমজুর আত্মহত্যার সংখ্যা ‘শূন্য’ দেখানো হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অন্তর্গত এনসিআরবি’র সমীক্ষা রিপোর্ট প্রতি বছর সাধারণত জুলাই বা আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়। তবে এবার দেরি করে এই রিপোর্ট সামনে আনা হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে সারা দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা লাফিয়ে ২৭.০৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে, জানাচ্ছে এনসিআরবি’র রিপোর্ট। আত্মঘাতীদের তালিকায় রয়েছেন নানা বয়সী পড়ুয়া, গৃহবধূ, ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী, পেশাজীবীরা। রিপোর্টের মর্মান্তিক তথ্য, ২০২২ সালে ১৩ হাজারেরও বেশি পড়ুয়া অকালে নিজেদের জীবন শেষ করে দিয়েছে। এর মধ্যে ১০,২৯৫ জন আত্মঘাতী পড়ুয়ার বয়স ১৮ বছরের নিচে। ছাত্রদের (৪,৬১৬) তুলনায় আত্মঘাতী ছাত্রীদের সংখ্যা (৫,৫৮৮) সামান্য বেশি। পড়াশোনার অত্যধিক চাপ সইতে না পারা, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, ভবিষ্যতের চিন্তাজনিত হতাশা ইত্যাদি কারণেই পড়ুয়াদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি।
NCRB FARMERS
ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য, এদেশে প্রতিদিন আত্মঘাতী ১৫৪ জন কৃষক, দিনমজুর
×
Comments :0