UTTARBANGA POST EDITORIAL

উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক সমীকরণ

রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

অশোক ভট্টাচার্য

‘‘একবার উত্তর বাংলা আসিয়া যান
হামার জাগাখান দেখিয়া যান
মনের কথা ক’থা বলিয়া যান রে, বন্ধু
হামার কথাও শুনিয়া যান রে।’’
জলপাইগুড়ি জেলার বিশিষ্ট ভাওয়াইয়া গায়ক ও গীতিকার ধনেশ্বর রায়ের এই গানটি উত্তরবঙ্গে খুবই জনপ্রিয়। ধূপগুড়ি বিধানসভা উপনির্বাচনে এই গানের কলিতে ধূপগুড়ির ভোটদাতাদের কাছে বামফ্রন্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট দানের আবেদন জানিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট ভাওয়াইয়া শিল্পীরা। নির্বাচনের ফলাফল সকলেরই জানা। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের ২৫ শতাংশ ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে উত্তরবঙ্গের ৮টি জেলার এলাকা। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ মানুষ বসবাস করে উত্তরবঙ্গের এই ৮টি জেলায়। উত্তরবঙ্গের জনবিন্যাসের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো এই অঞ্চল বহু জাতিক, বহু সাংস্কৃতিক, বহু ভাষিক। ‍‌এই অঞ্চলে যেমন বাংলা ভাষী মানুষ বসবাস করে তেমনি বসবাস করে গোর্খা, হিন্দি, রাজবংশী, শাদ্রী, কুরুক, সাঁওতালি, সহ বহুভাষা ও উপভাষী মানুষ। রাজবংশীরাই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী। এই অঞ্চলে যেমন বহু আদিবাসী মানুষ বসবাস করে যারা আদি-অধিবাসী, তেমনি বসবাস করে বহু অভিবাসিত আদিবাসী। এই অঞ্চলে বসবাস করেন বহু হিন্দু ধর্মীয় মানুষ, তেমনি বসবাস করে বহু ইসলাম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মীয় মানুষ।
উত্তরবঙ্গের মানুষ মূলত বসবাস করে গ্রামে। তাদের অধিকাংশের জীবিকা কৃষি, কয়েক লক্ষ বাগিচা শ্রমিক কাজ করে কয়েক শত চা বাগানে। শিক্ষার হার ক্রমবর্ধমান। আত্মপ্রকাশ ঘটছে গ্রাম ও শহরে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির। বৃদ্ধি পাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। বাড়ছে অ-কৃষি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষের সংখ্যা।
উত্তরবঙ্গের জনবিন্যাসগত দিক দিয়ে এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে জীবিকাতে। তার প্রভাব পড়ছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। বহু মানুষের চাহিদা, প্রত্যাশা, খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপনের পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে। বিগত বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকে উত্তরবঙ্গে বহু গ্রামের সাথে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বা অভিগম্যতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক গ্রাম আধা শহর বা অ-বিধিবদ্ধ শহরে পরিণত হচ্ছে। অনেক গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় শহুরে জীবন যাপনের প্রভাব পড়ছে।
উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজ


উত্তরবঙ্গের, উত্তরাঞ্চলে জনবিন্যাসগত পরিবর্তন সবচাইতে বেশিভাবে হচ্ছে। স্বাধীনতার পরে উত্তরবঙ্গ বলতে বোঝানো হতো ৫টি জেলা। দেশ ভাগের পূর্বে ছিল বৃহত্তর উত্তরবঙ্গ। যার মধ্যে ছিল জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দিনাজপুর, রংপুর, দার্জিলিঙের তরাই অঞ্চল আসামের গোয়ালপাড়া জেলা যা এক সময়ে রংপুর জেলার অন্তর্গত ছিল, এবং বিহারের পূর্ণিয়া জেলার বেশ কিছু অঞ্চলে রাজবংশী সমাজের মানুষরা বসবাস করতো। সেই সময়ে বৃহত্তর উত্তরবঙ্গে, রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষরাই ছিল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে রাজবংশীরাই পালন করতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, উত্তরবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে সমাজ বলতে বোঝাতো রাজবংশী সমাজকেই।
যদিও ইংরেজ শাসনে প্রশাসনিক কার্যাবলীর সুবাদে এই অঞ্চলে বর্ণ হিন্দুদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো। ইংরেজ শাসনের সময়ে বাংলার নতুন ভূমি নীতি, নতুন অর্থনীতি, নতুন শিক্ষা নীতির ফলে বর্ণ হিন্দুরা অর্থনীতি ও সমাজের নিয়ন্ত্রক হতে শুরু করলো। যদিও উচ্চ শ্রেণিভুক্ত হিন্দু জমিদারের সংখ্যা এক সময়ে এই অঞ্চলে ছিল সামান্যই। ইংরেজ শাসনের সময় তা কিছুটা বাড়তে শুরু করলো। অন্যদিকে রাজবংশী সমাজের মানুষদের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। একসময়ে রংপুর, দিনাজপুর জলপাইগুড়ির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জমিদার ও জোতদারদের মধ্যে রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজের মানুষের সংখ্যা যেমন বেশি ছিল, তেমনি বেশি ছিল কৃষিতে কাজ করা আঁধিয়ার ও কৃষি শ্রমিকদের মধ্যেও। সেই সময়ে আঁধিয়ারদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে জমিদার বা জোতদারদের সাথে আঁধিয়ারদের মধ্যে বহু সংঘাত হতো। যাকে শ্রেণি সংঘাত বলা যেতে পারে। অথচ বহু জমিদার ও আঁধিয়ার উভয়েই ছিল রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজভুক্ত। ১৯২০ সালের পর থেকে এই আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনই পরিণত হয় তেভাগা আন্দোলনে। সেই তেভাগা আন্দোলনের ফল ১৯৪৬ সালে বাংলার আইন পরিষদ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে দিনাজপুর কেন্দ্র থেকে রূপনারায়ণ রায়ের জয়। সেই সময়ে রেলওয়ে কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন জ্যোতি বসু, চা বাগান কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ। তেভাগা আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ছিল জমির মালিক ছিল হিন্দু উচ্চ বর্ণের বা রাজবংশী মানুষরা, কিন্তু জমিদারের প্রজা বা আঁধিয়ার ছিল রাজবংশী ও মুসলমানরা। ফলে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান আঁধিয়ার ও গরিব কৃষকদের মধ্যে এক সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠেছিল। ১৯২১ সালে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা প্রথম বাংলার আইন পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আরও দুইবার তিনি আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি শুধু একজন সমাজ সংস্কারকই ছিলেন না, তিনি উত্তরবঙ্গের কৃষকদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাংলার কৃষকদের স্বার্থবাহী এবং ভূমি বিষয়ক অনেকগুলি আইন তৈরি করার। তিনি রাজবংশীদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনার ডাক দিয়েছিলেন। ঠাকুর পঞ্চাননের মূল কর্মক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর রংপুর জেলা।
অবিভক্ত উত্তরবঙ্গে কৃষক আন্দোলন


পূর্ববঙ্গে জমির বিরোধ ছিল ধর্মের নয়, অর্থনীতির ১৯২৫ সালে বলেছিলেন গান্ধীজী। কিন্তু উত্তরবঙ্গে, বিশেষত রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি দেশীয় রাজ্য কোচবিহারে, দার্জিলিঙের সমতল অঞ্চলে এবং নিম্ন আসামে, ধর্মের ভিত্তিতে জমি বণ্টন হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জমির মালিক ও কৃষক বা আঁধিয়াররা একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সেই সময় রংপুর, দিনাজপুর বা জলপাইগুড়ি জেলার অধিকাংশ গরিব কৃষক ও আঁধিয়াররা ছিল রাজবংশী। আবার ধনী কৃষক, জমিদারদের বা জোতদারদের মধ্যে বেশি ছিল রাজবংশীরা। গরিব কৃষকদের ওপর জমিদার-জোতদারদের ছিল নানা ধরনের অত্যাচার। তাদের ওপর ছিল কর, সুদের বোঝা, হাটের তোলা বাজি, সবচাইতে বড় অত্যাচার ছিল উৎপাদিত ফসলের ভাগ না দেওয়া। রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজ, যারা ছিল মূলত ধনী কৃষক ও জোতদার জমিদার, তারা সব সময় চাইতো রাজবংশী গরিব কৃষক ও আঁধিয়াররা যাতে তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে না পারে। তার জন্যে তারা এই গরিব কৃষকদের নিজেদের সমাজ ও জাতের নামে সংঘবদ্ধ হওয়ার কথা বলতো। কিন্তু সমস্ত রকম প্রলোভন সত্ত্বেও সমস্ত গরিব রাজবংশী, মুসলমান ও আদিবাসী কষৃকরা জাত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এমনকি তারা গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও, পরে তারা জানায় জমিদার-জোতদার-ধনী কৃষকদের অত্যাচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তারা অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টি দাঁড়ায় কৃষকদের আন্দোলনের পাশে। ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষকসভা। ১৯৩৮ সালে কৃষকসভার দিনা‍‌জপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর জেলা কমিটি গঠিত হয়। সেই সময় কৃষকরা এই অঞ্চলে খাজনা বয়কটের আন্দোলনও গড়ে তুলেছিল। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় বহু গরিব আঁধিয়াররা তাদের প্রজাস্বত্ব বিক্রি করে দিয়ে বাধ্য হয় বর্গাদার বা শেয়ার ক্রপারে পরিণত হতে। পরবর্তীকালে তারা বিক্রি করতে বাধ্য হয় তাদের হাল বলদ। এইভাবে এদের অনেকে পরিণত হয় ভূমিহীন কৃষকে। ১৯৪৬-৪৭ সালে তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র উত্তরবঙ্গে ও বাংলায়। উত্তরবঙ্গে এই আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। দিনাজপুর জেলার সদর, বালুরঘাট ও ঠাকুরগাঁও মহকুমায়, রংপুর জেলার নিলফমারি, জলপাইগুড়ি জেলার সদর মহকুমায়।
১৯৪৬ সালের আইন পরিষদের নির্বাচনে রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজ, কংগ্রেস পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি পৃথক পৃথকভাবে লড়াই, করে। ক্ষত্রিয় সমাজ ৫টি আসনে লড়াই করেও একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারেনি। দিনাজপুর কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী। দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি জেলার রাজবংশী নিবিড় অঞ্চলে ক্ষত্রিয় সমাজ থেকে অনেক বেশি ভোট ‍পেয়েছিল কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীরা। জাত ও সমাজের নামে আবেগ সৃষ্টি করেও রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজ ঐ নির্বাচনে লাভবান হতে পারেনি। গরিব রাজবংশী কৃষকরা কিন্তু জাত, সমাজ, ধর্মের নামে সংঘবদ্ধ হয়নি। তারা সংঘবদ্ধ হয়েছিল শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্রেণিগতভাবে নিজেদের দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে।
উত্তরবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যাব ও বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা
১৯৪৭ সা‍‌লে দেশ ভাগ হয় এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়। দেশ ভাগ জনিত কারণে ১৯৪৭-৬১ এবং পরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তুর আগমন ঘটে এপার বাংলা পশ্চিমবঙ্গে। দেশ ভাগ মানে বাংলা ভাগও, পশ্চিমবঙ্গের ভাগে আসে অবিভক্ত বাংলার ৪০%, যার ৭০% ছিল হিন্দু, বেশ কয়েক লক্ষ মুসলমান পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে উদ্বাস্তু হয়ে চলে যায়। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু আগমনের এক বিরাট অংশ অভিবাসিত হয় উত্তরবঙ্গের তদানীন্তন ৫‍‌টি জেলায়। যদিও স্বাধীনতার অনেক আগেই উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলে কয়েক লক্ষ মানুষ নেপাল থেকে অভিবাসিত হয়। বিহারের ছোটনাগপুর থেকে কয়েকলক্ষ আদিবাসী শ্রমজীবী মানুষ অভিবাসিত হয় জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স ও দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলের বহু চা বাগানে। এই অভিবাসন উত্তরবঙ্গের জনবিন্যাসগত ও সামাজিক বিন্যাসগত অনেক পরিবর্তন ঘটায়। ১৯৫৫ সালে ভূমি সংস্কার আইন হলেও তার সেরকম কোনও কার্যকরী প্রভাব পড়েনি পশ্চিমবঙ্গে। যদিও সেই সময় উদ্বাস্তু সমস্যা আমাদের রাজ্যের কাছে অনেক বড় সমস্যা ছিল। সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা সমিতি তথা বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলে। যার পুরো ভাগে ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। এই আন্দোলন করতে গিয়ে বিশেষ করে জবর দখল কলোনি গড়ে তুলতে উদ্বাস্তুদের ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছিল। এই আন্দোলনের ফল স্বরূপ ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে বিধানসভা নির্বাচনে উদ্বাস্তুদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল বামপন্থীরা। পরবর্তী নির্বাচনগুলিতেও একই ধারা অব্যাহত থাকে। কমিউনিস্ট ও বামপন্থী পার্টিগুলির নেতৃত্বে আসেন এক ঝাঁক তরুণ। উদ্বাস্তু নেতৃত্ব। ১৯৭৭ সা‍‌লে রাজ্যে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবার পর কয়েকটি কর্মসূচির প্রতি বামফ্রন্ট সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। প্রথমত, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের চাষের জমি প্রদান ও বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত করা, বাস্তুহীনদের বাস্তু জমি প্রদান। দ্বিতীয়ত, শহর ও গ্রাম এলাকায় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের প্রথমে ৯৯ বছরের, পরে ৯৯৯ বছরের জমির নিরাপদ স্বত্ব বা লিজ প্রদান করা, পরবর্তীকালে উদ্বাস্তুদের শর্তহীন বাস্তু জমি প্রদান, উদ্বাস্তু এলাকায় পরিকাঠামো উন্নয়ন, স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থাপন করা হয়। বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও শহরে পৌরসভা। এই সমস্ত কর্মসূচিগুলির দ্বারা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে ও শহরের উদ্বাস্তুরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন কৃষক ল্যান্ড সিলিং-এর উদ্বৃত্ত জমি পায়, কয়েক লক্ষ কৃষক এবং কয়েক লক্ষ বর্গাদারের নাম নথিভুক্ত হয়। যারা কৃষি জমি পায় তাদের ‌মধ্যে একটি বড় অংশ পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তু বা নেপাল ও ভুটান থেকে অভিবাসিত। এই কৃষি জমি বণ্টন বা বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত করতে গিয়ে কোথাও কখনও সঙ্কীর্ণ ধর্মের প্রশ্ন আসেনি। বামফ্রন্ট সরকার যেমন গরিব মানুষের মধ্যে শ্রেণি চেতনা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিল, তেমনি মানুষের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারই উত্তরবঙ্গের লুপ্তপ্রায় বিভিন্ন লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল এবং অনেক কার্যকরী পদক্ষেপও তখন নেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষার ভিত তৈরি করে গেছে বামফ্রন্ট সরকারই। মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা বৃদ্ধি ও প্রসারেও বামফ্রন্ট সরকারের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বামফ্রন্ট সরকারই নেপালি বা গোর্খা ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তুর্ভক্ত করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিল। বামফ্রন্ট সরকারই প্রতিষ্ঠা করেছিল দার্জিলিঙ গোর্খা পার্বত্য পরিষদ, উদ্যোগী হয়েছিল আরও ক্ষমতাশালী পার্বত্য পরিষদ গঠনের এবং একে সংবিধানের ৬ষ্ঠ তফসিলিতে অন্তর্ভুক্ত করার মূল উদ্যোগী ছিল বামফ্রন্ট সরকারই! বামফ্রন্ট সরকারই গঠন করেছিল উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ। চেষ্টা করেছিল এ‍‌কে বিধিবদ্ধ রূপ দেবার। চা বাগান ও বনাঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের মধ্যে। অনেকগুলি সম্প্রদায়কে তফসিলি উপাজতি-জাতি ও ও‍‌বিসি’র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে মূল উদ্যোক্তা ছিল বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো এতৎসত্ত্বেও উত্তরবঙ্গে রাজবংশী সমাজের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি প্রবেশের চেষ্টা শাসক দলগুলি বিভিন্ন নামে করেছে, অথচ তা সত্ত্বেও নেপালি, নমঃশুদ্র ইত্যাদি সমাজ বা সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলির প্রতিও ছিল শ্রদ্ধাশীল। এই অংশের মানুষের প্রতি দিয়েছিল যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে। পরবর্তীকালে উত্তরবঙ্গের এই অংশের মানুষের থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। কিন্তু কেন? এই অংশের মানুষের মধ্যে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে আমাদের করণীয় কী? ভাবতে হবে তাও। উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক সামাজিক, উৎপাদনের একটি কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই সমস্ত মানুষের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষারও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের তা বোঝা প্রয়োজন অরও গভীরে গিয়ে। বিকল্প কর্মসূচিগুলি কী হবে? ভাবতে হবে তাও। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন সামাজিক সমস্যা, চাহিদা প্রত্যাশাগুলিকে আমাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আন্দোলন, সংগ্রাম, জনমত সৃষ্টির নতুন নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের করতে হবে অবহিত।
বিজেপি-তৃণমূল কংগ্রেসের মিথ্যে আশ্বাসন


যারা পাহাড়ে বা উত্তরবঙ্গে পৃথক রাজ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিটি নির্বাচনে ফায়দা লুটে চলেছে, তারা উত্তরবঙ্গের মানুষের ন্যূনতম আশা বা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। নতুন করে কোনও ভাষার স্বীকৃতিও আদায় করতে পারেনি। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদকে বিধিবদ্ধ সংস্থায় পরিণত করতে পারেনি। পার্বত্য পরিষদ বা জিটিএ’র বিন্দুমাত্র ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে পারেনি। অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েও পাহাড়ের নতুন কোনও অংশের মানুষকে তফসিলি জাতির স্বীকৃতি দিতে পারেনি। অথচ গত এক দশকের সমস্ত নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে বিজেপি’র মতো দক্ষিণপন্থী ও সাম্প্রদায়িক দলটির প্রাপ্ত ভোট ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যত শতাংশ ভোট বিজেপি’র পক্ষে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক তত শতাংশ ভোটই কমছে বাম ও কংগ্রেস প্রার্থীদের। উত্তরবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে রাজবংশী, গোর্খা, আদিবাসী, নমঃশুদ্র বা মতুয়া ভোটের বেশিরভাগ অংশই চলে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি’র পক্ষে। উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলে জাতি, উপজাতি সমাজ, কাস্ট, অঞ্চলভিত্তিক, জনগোষ্ঠীভিত্তিক বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীগুলিকে বিজেপি-তৃণমূল ক্রমেই গ্রাস করে নিচ্ছে। বিজেপি প্রভাব বিস্তার করেছে উদ্বাস্তু ও অভিবাসিত নব্য অভিবাসীদের মধ্যে। অথচ এই অংশের মানুষদের জন্য বিজেপি’র কোনও অবদান নেই।
চা বাগানের আদিবাসী শ্রমিকদের পক্ষে লড়াই সংগ্রামে বিশেষ করে ন্যূনতম মজুরি নীতি ও বাস্তুজমির আন্দোলনে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও ভূমিকা নেই, অথচ গত এক দশকের প্রতিটি নির্বাচনে এদের ভোট প্রাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। চা বাগানের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা রয়েছে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলির। বছরভর তারাই করে আন্দোলন কিন্তু ভোট পায় বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেস।
বিভিন্ন আঞ্চলিক, স্থানীয় দল বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলিকে নানা আশ্বাসন দিয়ে তারা এদের ভোট সংগ্রহ কর‍‌তে চায়। বিজেপি আবার এই সমস্ত জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে তাদের স্থানীয়  বা নিজস্ব বিষয় গুলিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে প্রাধান্য দেয় হিন্দুত্বকে। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের কথায় বিজেপি ভোটের রাজনীতিতে একটি নতুন সমীকরণ করছে। যাকে বলা হয়— সাব অলটার্ন হিন্দুত্ব বা নিম্নবর্গীয় হিন্দুত্ব। তৃণমূল কংগ্রেস সমাজের বিভিন্ন  অংশের মানুষকে নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি রাজনীতি এবং পার্টি সোসাইটি বা পার্টি সমাজ তৈরি করছে।  এভাবে তারা তাদের প্রাপ্ত ভোটকে বৃদ্ধি  করতে চায়। যেমন বিজেপি ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ১৭% ভোট পে‍‌লেও ২০১৬ সালে তাদের ভোট ৬% হ্রাস পায়। ২০১৯ সালে ৪০% ভোট পেলেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পায় ৩৮% তারপর থেকে বিজেপি প্রাপ্ত ভোট হ্রাস  পেয়েই  চলেছে পৌরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে বিভিন্ন বিধানসভা উপনির্বাচন পর্যন্ত। বিজেপি সমস্ত হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে পারছে না, পারবেও না। বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে  ভোটের মেরুকরণ কিছুটা হলেও ভাঙছে। ভোটের সমীকরণের একটি পরিবর্তন নজরে আসছে। কিছু‍‌ উদাহরণে আসা যেতে পারে — উত্তরবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে গোর্খা, রাজবংশী, নমঃশূদ্র, মতুয়া, চা বাগানের আদিবাসী ভোটেও শ্লথ গতিতে হলেও একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিছুটা হলেও মেরুকরণের কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন বিমল গুরুং, অনন্ত মহারাজ,  বংশীবদন প্রমুখের। পাহাড়ের আর পিপিএস বা পাহাড়ের স্থায়ী সমস্যা সমাধানের কথা আর শোনা যায় না। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করার নামে বিজেপি দেখাতে চায় তারা কত সততা ও স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করে। তারা নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিজেপি দেখাতে চায় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শুদ্র জাতি, জনজাতি,  জনগোষ্ঠী, সমাজ বা সম্প্রদায়গু‍‌লির সার্বিক উন্নয়নের জন্য তারা নাকি অনেক কিছু করছে। কিন্তু তাদের  এসব আশ্বাসন যে মিথ্যে, মানুষ তা বুঝতে পারছে। বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট কোনও মতেই স্থায়ী হতে পারবে না। এই দুই দলের ভোটের  মেরুকরণ ক্রমেই ভাঙতে বাধ্য। উত্তরবঙ্গেও রাজনীতির ক্ষেত্রে হবে এক নতুন সমীকরণ।

Comments :0

Login to leave a comment