শুভাশিস ভৌমিক: আমেদাবাদ
ব্রাত্যজনেরাই মুক্ত সঙ্গীত গাইল বিশ্বকাপ জুড়ে!
ব্রাত্য ছিলেন কারা? রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, কেএল রাহুল, শ্রেয়স আইয়ার, জসপ্রীত বুমরারা। তাঁদেরকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছিল। সঙ্গী হয়েছিল একের পর এক ব্যর্থতা। টি-২০ বিশ্বকাপ। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে হার। সমালোচনার ঝড় সামলাতে হয়েছিল ভারতীয় দলকে। ছ’মাস আগেও এই দলটার উপর কেউ বাজি ধরেনি। তাঁরাই ‘আজ’ ফাইনালে। স্বপ্নের যাত্রাই বলা যায়।
সময়টা বদলে যায় এশিয়া কাপ থেকে। কেএল রাহুলের প্রত্যাবর্তন, শ্রেয়স আইয়ারের চোট সারিয়ে রানে ফেরা, বল হাতে জসপ্রীত বুমরা, কুলদীপ যাদবদের ভরসা জোগানো, মহম্মদ সামির বিপক্ষের হাড় কাঁপিয়ে দেওয়া বোলিং, সর্বোপরি অধিনায়ক রোহিতের বিচক্ষণ অধিনায়কত্ব, আক্রমণাত্মক বোলিং। তাতেই অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো মসৃণ গতিতে ছুটে চলছে। শেষ দেড় মাস জুড়ে ভারত যে নির্মম, ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলেছে, তাতে নাস্তানাবুদ হয়েছে একের পর এক প্রতিপক্ষ। এটাই সবচেয়ে বড় চমক রোহিত অ্যান্ড কোংয়ের। সেদিন যারা ভরিয়ে দিয়েছিলেন সমালোচনায়, তাঁরাই এখন প্রার্থনা করছেন ভারতের হাতে বিশ্বকাপ ওঠার। রবিবার ভারতীয় দলের হাতে বিশ্বকাপ উঠতে চলেছে, চোখ বুজলেই সেই স্বপ্ন দেখছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।
যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট ভারত খেলেছে বিশ্বকাপ জুড়ে সেই ধারা বজায় রাখতে পারলেই, কাপ আর ঠোঁটের মাঝের ছোট্ট ব্যবধানটুকুও ঘুচে যাবে। বিশ্বজয় করা যদি এভারেস্ট ওঠার সমান হয়, গত ৮ অক্টোবর বেসক্যাম্প থেকে রোহিতরা যে যাত্রাটা শুরু করেছিল, ৪০ দিন পর শেষ শৃঙ্গ থেকে তাঁরা মাত্র একধাপ দূরে দাঁড়িয়ে। মোতেরা স্টেডিয়ামে আসল পরীক্ষা রবিবার। ব্যর্থ হলে এতদিনের কঠোর পরিশ্রম, সংকল্প, পরিকল্পনা সবকিছুই বৃথা হয়ে যাবে।
ভারতের উপর প্রত্যাশার চাপ যেমন রয়েছে, তেমনই থাকবে ১৪০ কোটি ভারতবাসীর সমর্থন। রবিবার গ্যালারি থেকেই ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি মানুষ রোহিত-বিরাটদের নাম ধরে চেঁচাবে। ১৯৮৩, ২০১১ সালের পর বিশ্বজয়ের স্বপ্নে মশগুল আপামর ভারতবাসী। যে গুজরাট ফাইনালের দু’দিন আগে শান্ত ছিল শনিবার তাঁদেরই গলা থেকে শোনা গেল ‘জিতেগা ভাই জিতেগা ইন্ডিয়া জিতেগা’। এঁদের মধ্যে একজন, নাম অনিরুদ্ধ কৌশিক। যিনি আমেদাবাদের বাসিন্দা। তিনি বলছেন, ‘ ২০০৩ সালে জোহানেসবার্গের হারের হিসাব বরাবর করার আদর্শ মঞ্চ আমেদাবাদ।’ রোহিতরা কি পারবেন সেদিনের হারের দগদগে ক্ষতে মলম লাগাতে?
এদিন রোহিত গান্ধীনগরের অদালজ কুয়োর মধ্যে ঢুকে বিশ্বকাপের সঙ্গে ছবি তুললেন। সন্ধ্যায় হাসিমুখে সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁর চোখে জ্বলজ্বল করছিল অধরা মাধুরী ছোঁয়ার বাসনা ( রোহিত টি-২০ বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতলেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পাননি)। তাঁর নেতৃত্বে একযুগ পর ফের ভারত ফাইনালে উঠেছে। একটানা ৪০ মিনিট। চেয়ারে শান্তভাবে বসে, মার্জিত ভাষায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তিনি দিলেন। বললেন, ‘আমার কেরিয়ারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা। নেতৃত্ব গ্রহণ করার প্রথম দিন থেকে এই দিনটার প্রস্তুতি নিয়েছি। কোচ ও আমি মিলে দলের প্রত্যেকটি ক্রিকেটারকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। ইতিবাচক মানসিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। রাহুল ভাইয়ের কৃতিত্ব বিশাল। উনি সবাইকে স্বাধীনতা দিয়েছেন খোলা মনে খেলার।’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘ফাইনালের বাড়তি চাপ না নিয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করছি। এটাই আমাদের মূলমন্ত্র। ফাইনাল মানে ক্রিকেটারদের মনে চাপ থাকবেই। এটা খুবই স্বাভাবিক। আসলে ম্যাচের আগে সকলকে মানসিকভাবে তরতাজা থাকার সুযোগ দিতে চাই। প্রত্যাশা, চাপ, সমালোচনা সবটাই জানি। আমরা ড্রেসিংরুমে শান্ত থাকার চেষ্টা করছি। ম্যাচেও চাপের পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় সেখান থেকে বেরনোর রাস্তা খুঁজছি। প্রত্যেকে ব্যক্তিগত ভাবে কী ভাবছে, সেটা আমার বোঝার কথা নয়, দলের অন্দরের ক্ষেত্রে বলতে পারি, প্রত্যকেই জানে দেশের হয়ে খেললে চাপ থাকবে। আমাদের সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়।’
শিশির ফ্যাক্টর। ছোট বাউন্ডারি। অনেকে মনে করছেন, পুরো প্রতিযোগিতার মতোই ফাইনালেও নাকি টস ফ্যাক্টর হবে? রোহিত পুল করে সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিলেন, যে ভালো খেলবে, সেই দলের হাতেই ট্রফি উঠবে। মন্থর উইকেট হওয়ার কারণে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের খেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, আমেদাবাদে ভারতীয় দল পা দেওয়ার পর থেকে। এবং টানা দু’দিন অনুশীলনে এলেন অশ্বিন। ব্যাটিং, বোলিং দু’ই করলেন। এরপর রোহিত যতই ফাইনালে ম্যাচের একাদশ নিয়ে ধোঁয়াশা রাখুক না কেন, তিন স্পিনার নিয়ে নামার কোনও সম্ভাবনাই নেই। যদি এই দলে হার্দিক পান্ডিয়া থাকতন, তখন টিম থিঙ্কট্যাঙ্ক ভেবে দেখতেন অশ্বিনকে খেলানোর কথা। বিগ ফাইনালে ভারতীয় দল উইনিং কম্বিনেশন ভাঙবে না লিখে দেওয়াই যায়। ম্যাচের আগের দিন ভারতীয় দল হালকা অনুশীলন করেছে। দলের ১৫ জনই রয়েছেন খোশমেজাজে। যে ক’জন এসেছিলেন শেষ মহড়ায়, প্রস্তুতির ফাঁকে হাসি-হাট্টা করলেন নিজেদের মধ্যে। যা খুবই ইতিবাচক দিক।
দশে দশ হয়েছে। ফাইনাল জিতলে হবে এগারোতে এগারো। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অস্ট্রেলিয়ার রয়েছে দু’বার (২০০৩, ২০০৭)। ফাইনালে অজিদের হারিয়েই তাঁদের কৃতিত্ব স্পর্শ করার অনন্য নজির হাতছানি ভারতের সামনে।
Comments :0