Parliament Winter Session 2023

সরব হলেই মুখ বন্ধের ফতোয়া বারংবার

জাতীয়

 মূল্যবৃদ্ধি থেকে মণিপুর জাতি সংঘর্ষের ঘটনা, কোনটাই নিয়ে আলোচনা বরদাস্ত করতে রাজি নয় মোদী সরকার। সংসদে সরব হলেই সাসপেন্ড অনিবার্য! একারণেই সাসপেন্ড হতে হচ্ছে বিরোধী সাংসদেরই। প্রশ্ন তুললে মুখ বন্ধ করে দেওয়াই কেতা হয়ে দাঁড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদীদের। জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা সংসদে লাটে উঠেছে, বিল নিয়ে বিস্তরিত আলোচনার যে রীতি দীর্ঘদিনের সংসদীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটাও এখন প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছে। বিনা আলোচনায় পাশ হয়ে যায় এই আমলের বিল। সোমবারও সংসদের দুই কক্ষে স্রেফ সংসদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের বিবৃতি দাবি করেছিলেন বিরোধীরা। পরিণামে সংসদের দুই কক্ষ মিলে সাসপেন্ড করা হয়েছে বিরোধী দলের মোট ৭৮ জন সাংসদকে। চলতি শীতকালীন অধিবেশনের এখন পর্যন্ত সাসপেন্ড করা হয়েছে ৯২জনকে। বাকি দিন আর সংসদে ঢুকতে পারবেন না সাসপেন্ড হওয়া বিরোধীরা। সংসদকে এভাবে বিরোধীশূন্য করে দিয়েই হয়ে যাবে একে একে গুরুত্বপূর্ণ সব বিল পাশ। কার্যত বিরোধীদের বাদ দিয়ে সংসদের বিল পাশের এই পদক্ষেপ নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই কার্যত সংসদীয় ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে বলা যায়। তাদের এখন আক্রমণের নিশানা হয়েছে সংসদ। সংসদ সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর সংসদে ১৪৯ বার বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। কোনও সাংসদ দেখা গিয়েছে একাধিক বার সাসপেন্ড হয়েছেন। এবার চলতি অধিবেশনে দুই কক্ষ মিলে ৯২ জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, শেষ ১৯৮৯ সালে সর্বাধিক মোট ৬৩ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। এবারে মোদী জমানায় সাসপেন্ড সাংসদের সংখ্যা সেই রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতীয় সংসদে এত বেশি সংখ্যক বিরোধী সাংসদ সাসপেন্ড হননি।
এদিকে, মোদী সরকার বিরোধীদের সংসদমুক্ত করেই কোনওরকম বিরোধিতা ছাড়া বিল পাশের লক্ষ্যে ঢালাও সাসপেন্ড করার পথ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কংগ্রেস সভাপতি তথা রাজ্যসভার সদস্য মল্লিকার্জুন খাড়গে। তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রকে আজ হত্যা করা হয়েছে। স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়েছে। মোদী সরকার গুরুত্বপূর্ণ সব বিল সংসদে বিনা বাধায় পাশ করাতেই বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। তিনি বলেন, মোদী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আজ তলানিতে ঠেকেছে। প্রথমে সংসদে অনুপ্রবেশকারীরা হামলা দেখালো। এবারে সংসদে মোদী সরকার বিরোধীদের উপর হামলা চালাচ্ছে। সিপিআই(এম) সাংসদ এলামারাম করিম বলেছেন, বিরোধী সাংসদদের এই সাসপেন্ড গণতন্ত্রের উপর বড় আঘাত। এতে সাংসদদের স্বাধীনভাবে কথা বলা ও প্রতিবাদ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
এদিন সংসদে বিল পাশে বিরোধীদের বাধা সরাতে এই সাসপেন্ড অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিরোধীরা। যেমন এদিন লোকসভায় সাসপেন্ডের হট্টগোলে পাশ হয়ে গেছে ডাকঘর বিল। এই বিলে ডাকঘরে যেসব পোস্ট হবে তা অবাধে খুলে দেখার অধিকার থাকবে সরকারের। এতে যে গোপনীয়তা রক্ষা হতো তা আর থাকবে না। বিরোধীরা বিলে প্রবল আপত্তি জানালেও বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করার পর হট্টগোলে প্রায় বিনা আলোচনায় বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। অধিবেশন শেষ হওয়ার আগের দিন আগামী বৃহস্পতিবার পাশ করার জন্য তিন ফৌজদারি বিল তালিকায় রয়েছে তা হলো, ভারতীয় ন্যায়সংহিতা বিল, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা বিল এবং ভারতীয় সাক্ষ্য বিল। পুরো ফৌজদারি আইন পরিবর্তনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনার সময় বাড়ানোর দাবি উঠলেও তা শোনা হয়নি। এবারে বিরোধী সাংসদ সাসপেন্ড করে বিনা আলোচনায় এই বিল পাশ করিয়ে নেওয়ার পথ নিয়েছে মোদী সরকার। উল্লেখ্য, মোট ১৮ বিল আনা হয়েছে চলতি অধিবেশনে। আর বিরোধীরা সরব হলেই তাঁদের সাসপেন্ড করার পথ নিয়েছে সরকার। তার মাঝে বেশিরভাগ বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে মোদী সরকার। বিরোধীরা জানাচ্ছেন, মোদী জমানায় সংসদকে একটা গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সংসদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিল। তা নিয়ে আলোচনার পর তা পাশ করানো হয়। অলোচনার পরিধি বাড়াতে সংসদীয় কমিটিতে নিয়ে বিল আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মোদী জমানায় বেশিরভাগ বিল আর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয় না। তা পেশের পর সামান্য আলোচনার পর শাসক দল সংখ্যার জোরে পাশ করিয়ে নেয়। এবারে বিরোধীদের সেই সামান্য আলোচনার সুযোগ রাখা হয়নি। তাদের সাসপেন্ড করে সংসদ থেকে সরাসরি বের করে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, মোদী জমানায় শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলায় সরব হতে গিয়ে বারে বারে সাসপেন্ড হতে হয়েছে বিরোধীদের। যেমন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন বিরোধীরা। 
দেশে প্রতিদিন সমস্ত কিছুর দাম বেড়ে চলেছে। অথচ কেন্দ্র নীরব। সরকারের বিবৃতি দাবি করায় বাদল অধিবেশনে উপেক্ষা করে কেন্দ্র। বিবৃতির দাবিতে প্রতিবাদে সরব হওয়ায় বিরোধী দলের ১৯ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিরোধীদের কণ্ঠরোধে শাসক দল সফল হয়েছিল বলে মনে করে। এবছর বাজেট অধিবেশনে মোদীর জবাবী ভাষণে বিরোধীরা বক্তব্য রাখার সময় বিজেপি’র বিরোধী সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগে আনায় তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। সেই বিরোধী কংগ্রেস সাংসদ হলেন রজনী পাতিল।
এদিকে মণিপুরে দিনের পর দিন জাতি সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যু ঘটনা ঘটলেও প্রধানমন্ত্রী মোদী নীরব। মণিপুরে জাতি সংঘর্ষের পিছনে বিজেপি রাজ্য সরকারের ভূমিকা সংসদে তুলেছেন বিরোধীরা। বিরোধী মুখ বন্ধ করতে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয় চারজন বিরোধী সাংসদকে। এবছর ২৪ জুলাইয়ের ঘটনা। বিজেপি বিরোধী সাংসদের নামে মিথ্যা অভিযোগ আনায় তার প্রতিবাদ করায় সেই বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। গত ৫ মার্চ বাজেট অধিবেশনে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাসভবন থেকে করোনা ছড়িয়েছে অভিযোগ এনে কেন্দ্রকে তদন্তের দাবি জানান বিজেপি’র রাজস্থানের সাংসদ। এক কংগ্রেস সাংসদ মিথ্যা অভিযোগের প্রতিবাদ জানানোয় তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। বিজেপি সাংসদের মিথ্যা অভিযোগের কোনও বিচার হয় না।
প্রধানমন্ত্রী মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় যেভাবে বিধানসভা চালাতেন ঠিক একইভাবে সংসদ চালাচ্ছেন। একথা জানিয়েছেন কংগ্রেসের মুখপাত্র গৌরব গগৈ। তিনি বলেন, গুজরাটে বিরোধিদের বিধানসভায় কথা বলার কোনও অধিকার বরদাস্ত করতেন না মুখ্যমন্ত্রী মোদী। এবারে সংসদে তা চালু হয়েছে বিরোধীদের বরদাস্ত করতে পারছেন না। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরি বলেন, ‘‘মোদী সংসদকে নিজেদের দলীয় কার্যালয় বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। তাই সেখানে বিরোধীদের কোনও স্থান নেই তাঁদের একের পর সাসপেন্ড করা হচ্ছে। মোদী ঘনিষ্ঠ আদানির বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য বিরোধী দলের সাংসদ বহিষ্কার হয়েছেন।’’

Comments :0

Login to leave a comment