নিলয়কুমার সাহা
ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যের সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ আজও নির্দিষ্ট আছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপালের জন্য। যৌথ তালিকাভুক্ত উচ্চশিক্ষার যথার্থ বিকাশ এবং গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যের ‘যুক্ত সাধনা’র ক্ষেত্র নির্মাণই ছিল এই পদ্ধতির ভিত্তি। সময়ের আবহে, রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে তা বহুলাংশে বিবর্ণ হলেও একেবারে বর্ণহীন হয়ে পড়েনি। ২০১৪ সাল থেকে সময় যত এগিয়েছে পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান এবং প্রশাসনিক প্রধানের কৃত্রিম রাজনৈতিক দ্বৈরথ। অম্ল-মধুর এই সম্পর্কের পারদ রাজ্যের উচ্চশিক্ষায় এক নজিরবিহীন ক্ষেত্র নির্মাণ করেছে। ২০২২ সালের ১৩ জুন রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকার বিধানসভায় ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২’ পেশ করে এবং ২৯৪ আসন বিশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ১৮২-৪০ ভোটে বিলটি গৃহীত হয়। বিধানসভায় গৃহীত এই বিলটি রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য এরপর রাজভবন পাঠানো হয় এবং সম্ভবত সুদূরপ্রসারী কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার কারণেই সেই বিল আজও রাজভবনে ফাইল বন্দি। এমতাবস্থায় বিগত আট মাসে এই দুই ব্যক্তিত্বের নাটকীয় রাজনৈতিক সংঘাতে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে প্রশাসনিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই অস্থিরতার ফলস্বরূপ মহামান্য আদালতের হস্তক্ষেপে দেশের এক সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে যেভাবে অপসারিত হতে হয়েছে তা সত্যিই অকল্পনীয়! এমনিই এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অতি সম্প্রতি রাজভবন ও নবান্নের ‘যৌথ বোঝাপড়া’ বসন্ত উৎসবের প্রাক্কালে বঙ্গের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রকে যেভাবে রাঙায়িত করেছে তা সত্যিই অভূতপূর্ব। রাজ্য প্রশাসনের এই দুই বিপরীতমুখী অবস্থানে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্র প্রকৃতপক্ষে কতটা গৌরবান্বিত হল, সে পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটেই মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য সরকার কর্তৃক উপাচার্য নিয়োগ এবং সাম্প্রতিক পুনর্নিয়োগকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে।
উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত ইউজিসি’র নির্দেশিকা
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ (ইউজিসি) দেশের সমস্ত রাজ্য পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিধি চূড়ান্ত করে আসছে। ইউজিসি নির্দেশিত নির্দেশিকা অনুসারেই সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াও বর্তমান। এই নির্দেশিকা অনুযায়ী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে দশ বছর অধ্যাপক পদে কর্মরত কোনো ব্যক্তি অথবা প্রখ্যাত কোনো গবেষণা বা প্রশাসনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে দশ বছর অধ্যাপক পদের সমতুল কোনো পদে কর্মরত ব্যক্তিই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হতে পারেন। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হল ‘সার্চ কমিটি’ গঠন। ২০১৮ সালের সার্চ কমিটি গঠন সংক্রান্ত ইউজিসি’র নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে একজন রাজ্যপাল তথা আচার্যের প্রতিনিধি, একজন রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি, একজন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট অথবা কোর্ট অথবা কাউন্সিলের প্রতিনিধি এবং একজন অন্য রাজ্যের প্রতিনিধি থাকবেন। এই নির্দেশিকায় আরো বলা হয়েছে, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বা শিক্ষা প্রশাসকদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠিত হবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক অথবা শিক্ষা প্রশাসক সার্চ কমিটির সদস্য হতে পারবেন না। সার্চ কমিটি ইউজিসি নির্দেশিত নিয়মাবলী অনুসারে তিন থেকে পাঁচ জন যোগ্য ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করবে এবং সেই তালিকা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য রাজভবনে পাঠানো হবে। রাজ্যপাল সার্চ কমিটি প্রেরিত তালিকা থেকে একজন প্রার্থীকেই নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগের সুপারিশ করবেন এবং তিনি তাঁর সুপারিশ রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরে পাঠিয়ে দেবেন। এরপর শিক্ষা দপ্তর রাজ্যপাল মনোনীত ব্যক্তিকেই নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে চার বছরের জন্য নিয়োগ করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিগত এক দশকে আমাদের রাজ্যে ন্যূনতম পরিকাঠামো ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৩ থেকে বেড়ে ৩১ হয়েছে। শতাংশের হিসাবে ১৩৮ শতাংশ। এই সময়ে রাজ্য পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্থায়ী উপাচার্য অপেক্ষা অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের আধিক্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ইউজিসি’র নিয়ম উপেক্ষা করে ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়াই উপাচার্য পদে নিয়োগের ঘটনা আমাদের রাজ্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে রাজ্য সরকার অথবা রাজ্য সরকারের উচ্চ শিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক গঠিত সার্চ কমিটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাজ্যপালের এই অনৈতিক যৌথ কর্মসূচিতে রাজ্যের লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যত আজ বিপন্ন! এমতাবস্থায় অতিসম্প্রতি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান এবং প্রধান এবং প্রশাসনিক প্রধানের অতিসক্রিয়তায় উপাচার্য পুনর্নিয়োগের বিষয়টি মহামান্য আদালত অবৈধ ঘোষণায় পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে গভীরতর সঙ্কট।
দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২
জগদীপ ধনখর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসাবে ২০২২ সালের ১৭ জুলাই পর্যন্ত আসীন ছিলেন। রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের কিছুকাল পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যের সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক দুই শীর্ষ ব্যক্তিত্বের আপাত বিরোধী অবস্থান। যদিও এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের পিছনে ছিল গভীর রাজনৈতিক বোঝাপড়া যা রাজ্যের উচ্চশিক্ষার আঙিনায় সৃষ্টি করেছে অবর্ণনীয় এক কলঙ্কিত অধ্যায়। রাজভবন এবং নবান্নের নাটকীয় সংঘাতের আবহে রাজ্য সরকার ২০২২ সালের ১৩ জুন বিধানসভায় ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২’ উপস্থাপন করে এবং সংখ্যাধিক্যের ভোটে বিলটি বিধানসভায় পাশ হয়। রাজ্য সরকার এই বিলটিতে রাজ্য পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ থেকে রাজ্যপালকে সরিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য পদে স্থলাভিষিক্ত করে। এরপর এই বিলটি রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য রাজভবনে পাঠানো হয় এবং সম্ভবত কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ রাজনৈতিক সমীকরণের কারণেই সেটি রাজভবনের লাল ফিতের ফাঁসে আটকে যায়। ইতিমধ্যে রাজ্যের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাজ্য সরকার ইউজিসি নির্দেশিত সার্চ কমিটি গঠন না করেই কোনো কোনো উপাচার্যকে তিন মাস অথবা ছয় মাস এবং কয়েকজন উপাচার্যকে চার বছরের জন্য পুনর্নিয়োগ করে। রাজ্য সরকার কর্তৃক উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি মামলা দায়ের হয়। এই মামলার রায় দানের সময় প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ বলেন, ক্যালকাটা ইউনির্ভাসিটি অ্যাক্ট অনুসারে [ধারা ৮(১)(বি)] সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করতে পারে না, উপাচার্য নিয়োগ করবেন আচার্য। এই রায়ের ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পুনর্নিয়োগ অবৈধ ঘোষিত হয় এবং উপাচার্যকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আদালতের এই রায়ের পর রাজ্যব্যাপী উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয় কারণ রাজ্যের প্রায় সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যপদে কর্মরত সকলেরই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বৈধতার প্রশ্নটি সর্বসমক্ষে চলে আসে। এই বিষয়ে মহামান্য আদালতের রায়ে সাধারণের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়।
রাজভবন ও নবান্নের অকৃত্রিম বোঝাপড়া
বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে যে নজিরবিহীন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, দলমত নির্বিশেষে সকল সচেতন অভিভাবকই এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত। একদিকে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, একাধিক শিক্ষা অধিকর্তা সহ এক উপাচার্য রাজ্যের যোগ্য মেধাবী হবু শিক্ষকদের বঞ্চিত করে লক্ষ লক্ষ টাকায় অযোগ্যদের কাছে চাকরি বিক্রির অভিযোগে হাজতবাস করছে। অন্যদিকে বঞ্চিত যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা ন্যায় বিচারের আশায় প্রায় দু’বছর মহানগরের রাজপথে ধরনামঞ্চে অবস্থান-বিক্ষোভ কর্মসূচিতে প্রাণপাত করছে। এই বিপরীতমুখী স্রোতের ঘূর্ণাবর্তে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক সকলেই আক্রান্ত। দমবন্ধ করা এই পরিস্থিতি থেকে সকলেই চাইছে মুক্তি, চাইছে পরিত্রাণ। কিন্তু কিভাবে এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ মিলবে বঙ্গবাসীর? রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসকের সদিচ্ছা ব্যতিরেকে এই বিপর্যয় থেকে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যদিও রাজ্য সরকার এখনও পর্যন্ত পাহাড়প্রমাণ এই সমস্যা নিরসনে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কেবলমাত্র মহামান্য আদালতের হস্তক্ষেপেই নিয়োগ দুর্নীতির ভয়ঙ্কর রূপ জনসমক্ষে এসেছে এবং মহামান্য আদালতের নির্দেশেই প্রতিদিন উন্মোচিত হচ্ছে নিয়োগ দুর্নীতির নতুন নতুন দিগন্ত। পাশাপাশি আদালতে মহামান্য বিচারপতিগণ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার তদন্তের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বার বার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার তদন্তের গতিপ্রকৃতি সচেতন রাজবাসীর মনে যে আশঙ্কা তৈরি করেছে তা হলো, কেন্দ্র এবং রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণের চোরা বালিতে হারিয়ে যাবে না তো এত বড় নিয়োগ কেলেঙ্কারির কুশীলবেরা।
ইতিমধ্যে ড. সিভি আনন্দ বোস ২৩ নভেম্বর, ২০২২ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শ্রীপঞ্চমীর সকালে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করে রাজভবন এবং নবান্নের ‘আপাত-বিরোধী’ সম্পর্কের এক নতুন রসায়ন। ওই দিন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পৌরহিত্যে হাতে খড়ি হয় রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের। উৎসবের এই আবহে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করলেন রাজ্যভবন-নবান্নের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়। বিগত আট মাস ধরে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার নিরসন হয়ে গেল এক লহমায়। মাননীয় রাজ্যপালকে পাশে বসিয়ে রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জানান, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে এবং রাজ্যপালের দিক নির্দেশনায় কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হল। রাজ্যের কয়েকজন দন্ডায়মান উপাচার্যের সামনেই শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানান, রাজ্যর ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ রাজ্যপাল তথা আচার্যের কাছে তাঁদের পদত্যাগপত্র পেশ করবেন এবং আচার্য তথা রাজ্যপাল তাঁদেরকে পুনরায় তিন মাসের জন্য পুনর্নিয়োগ করবেন। এই তিন মাসের মধ্যে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর ইউজিসি নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্থায়ীভাবে উপাচার্য নিয়োগ করবে। উত্তম প্রস্তাব! কেবলমাত্র কৃত্রিম রাজনৈতিক বিরোধিতার ফলে রাজ্যে সৃষ্ট উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত আইনি সমস্যা সমাধানে রাজভবন এবং নবান্নের এই অভাবনীয় সুকৌশলী প্রক্রিয়াকে কুর্নিশ করতেই হয়। রাজভবন এবং নবান্নের এই পারস্পরিক সমঝোতায় বাংলার উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিন আশঙ্কার যে চোরাস্রোত বইছিল, এতদিনে সেই আশঙ্কার অবসান হলেও জন্ম দিল অনেক জিজ্ঞাসার। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে রাজ্যপালকে পুনরায় স্থলাভিষিক্ত করার সাথে সাথে কি পথ হারালো ‘দ্যা ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনির্ভাসিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২’? গণ বিবাহ বা গণ সৎকারের মতো মাননীয় উপাচার্যদের গণ পদত্যাগ এবং গণ পুনর্নিয়োগ কি বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাসকে আঘাত করল না? যদিও এক আধ জন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁরা এই পুনর্নিয়োগ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁদের মত, পথ যাই হোক তাঁরা অবশ্যই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। পরাধীন ভারতবর্ষে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ব্রিটিশ শাসক আর্থিক অনুদানের সাথে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিল যা ছিল দাসখত নেওয়ার নামান্তর! শাসকের এই আচরণের প্রতিবাদে উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সমাবর্তন সভায় বলেন, ‘‘চাই না টাকা। না খেয়ে থাকব। আমাদের মাস্টারমশাইরা না খেয়ে থাকবেন, তাও দাসত্ব স্বীকার করবে না। ফ্রিডম ফার্স্ট, ফ্রিডম সেকেন্ড, ফ্রিডম অলওয়েজ...’’। উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এই উক্তি কি পুনর্নিয়োগপত্র গ্রহণ করার সময় তাঁর উত্তরসূরিদের চিত্তকে আঘাত করেনি? মহামান্য আদালত রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পুনর্নিয়োগ প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে রাজ্যের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে সাময়িক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করলেও পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা কি সত্যিই বিপদমুক্ত হল? একটাই উত্তর, না।
Comments :0