Editorial

পুরস্কারের বদলে শাস্তি!

সম্পাদকীয় বিভাগ

বাইশ বছর আগে স্কুল বাঁচাতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে যে স্কুলছাত্র অভিনন্দিত হয়েছিল, এখন শিক্ষার অধিকারে সোচ্চার হওয়ায় তাকেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সাসপেন্ড করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ভারতেরই একটি নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এমন ঘটনা নিশ্চয়ই আমাদের সমাজের পক্ষে সুসংবাদ নয়। সর্বজনীন শিক্ষার জন্য যারা সমাজে লড়াই করছেন তাঁরা তো বটেই, বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে না দেখে উচ্চশিক্ষাকে মেধার নিরিখে বিবেচনা যাদের স্বস্তি দিয়ে থাকে তাঁদের সবার কাছেই এই ঘটনা উদ্বেগজনক। মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশাল সাইন্সেসে এই ঘটনা ঘটেছে। যেভাবে শিক্ষা অধিকারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে ছাত্রকে সাসপেন্ড করা হয়েছে তাতে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপরে আক্রমণের মাত্রাও স্পষ্ট হচ্ছে। 

২০০২ সালে কেরালার ওয়েনাডে এক পাহাড়ি গ্রামের একটি স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল সেখানকার ইউডিএফ সরকারের সিদ্ধান্তে। রাজ্যের যে সমস্ত সরকারি স্কুল ‘লাভজনক নয়’ সরকার তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেখানকার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র দলিত পরিবারের সন্তান রামদাস প্রীনি শিবনন্দন শিক্ষকদের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, স্কুলে তার অধিকাংশ সহপাঠীর বাবা মা চা বাগানের শ্রমিক, খেতমজুর, আদিবাসী কিংবা তারই মতো দলিত সম্প্রদায়ের। এই স্কুল বন্ধ হলে তার মতো বাকিরাও আর পড়াশোনা করতে পারবে না। ৯ বছর বয়সি স্কুলছাত্রের এই চিঠি পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে চিঠি পাঠিয়ে ঐ স্কুল বন্ধ না করার নির্দেশ পাঠানো হয়। সেই সঙ্গে রামদাসকে রাষ্ট্রপতি অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। শৈশবের এই অভিজ্ঞতা থেকেই রামদাস শিখেছিল সবার জন্য শিক্ষার দাবি করা অভিনন্দনযোগ্য, প্রশংসনীয় এবং সমাজের পক্ষে হিতকর। শুধু রাষ্ট্র ও সমাজের সব অংশ থেকে ঐ শিশু শিক্ষায় সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছিল। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী হয়েও, মেধার জোরে দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় রামদাস। কেন্দ্রীয় সরকারের বেশ কয়েকটি স্কলারশিপ পেয়ে মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশাল সাইন্সেস’এ পিএইচডি করা শুরু করে। ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকে পাঠ নিয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লড়াইয়ে শামিল হয়ে রামদাস বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির নেতাও হয়ে ওঠে। কিন্তু যে লাড়াইয়ের জন্য ছোটবেলায় রাষ্ট্রপতির অভিন্দন বার্তা মিলেছিল, তাঁর জন্যই এখন তাকে সাসপেন্ড হয়ে থাকতে হচ্ছে টিস থেকে। গত এক বছর ধরে টিস মুম্বাই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে, এই দলিত গবেষক ক্যাম্পাসে ঢুকতে পর্যন্ত পারছে না। শিক্ষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের নামে প্রতিষ্ঠানের অবমাননার অভিযোগে তাঁকে দু’বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। তার প্রাপ্য কেন্দ্রীয় সরকারি স্কলারশিপ আটকে দেওয়া হয়েছে। 

ভারতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অধিকারের দাবি করলে প্রশংসার বদলে শাস্তি জোটাটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এরকমই আক্রমণ নামিয়ে এনেছে এরাজ্যের শাসকদল, যাদবপুর তার সাম্প্রতিক নজির। দখলদারি কায়েমই এখানে শাসকদের লক্ষ্য, নির্বাচিত ছাত্র সংসদের দাবি করলে এখানে শিক্ষা মন্ত্রীর গাড়ি পিষে দিতে পারে। দেশজুড়ে আরএসএস একইভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে দখলদারি কায়েম করছে, যুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর শিক্ষার বদলে অন্ধবিশ্বাস, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ বপন করা হচ্ছে। ইউজিসি’র ফতোয়া দেখিয়ে, টিস’র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের এক বড় অংশের ছাঁটাইয়ের নোটিস জারি, শ্রম আইন, ক্যাম্পাসের গণতন্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধিকারের ওপর আক্রমণ, ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা এবং রামদাসকে সাসপেন্ড করা তারই নজির। কিন্তু রামদাস এবং তার সঙ্গী ছাত্র শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা শিক্ষার জন্য আদর্শগতভাবে লড়াই করছেন। রামদাস বামপন্থায় বিশ্বাসী। ভয় দেখিয়ে, সাসপেন্ড করে তাকে এবং এই আন্দোলনকে দমন করা যাবে না। 

Comments :0

Login to leave a comment