জয়রাজ ভট্টাচার্য
‘‘যে গণতান্ত্রিকতার প্রসার ঘটেছে বিংশ শতাব্দী জুড়ে, তার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সায় পাওয়া শক্ত বলেই আমার মনে হয়।’’ এই ‘মনে হওয়া’ অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘মনে হওয়া’, এবং রীতিমতো বিপজ্জনক ‘মনে হওয়া’। সর্বস্তরেই বিপজ্জনক ব্যাপারস্যাপার এড়িয়ে যেতেই আমরা অভ্যস্ত হয়েছি ইদানীং, রবীন্দ্রচর্চাও তার ব্যতিক্রম নয়। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ, তিনি এড়িয়ে যাননি, প্রভোক করেছেন। ভবানী সেনের পর থেকে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সকলেই সাবধানে পা ফেলেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে তো খুব সরলমতি শিশুতোষ নন, তাই অতটা সাবধান হতে গেলে, অনেকখানিই এড়িয়ে যেতে হয়। আর এই ধরনের এড়িয়ে যাওয়া, যে ফাঁকফোকর তৈরি করে, সেই ফাঁকটুকু খুঁজে নিয়েই, আজকের আগ্রাসী স্টেট মেশিনারি রবীন্দ্রনাথের ভেতরেও ঢুকে পড়তে চায়! ঢুকে পড়তে পারেও, গণতন্ত্রের নামেই পারে।
স্টেটিস্ট, বা রাষ্ট্রিক ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ বাহ্যিক বা আরোপিত আদর্শ মনে করেছেন ভারতের সমাজভাবনায়। স্টেটিস্ট ভাবনাটা সংজ্ঞায়িত তাই অবধারিত ভাবে রিজিড, আর তার বিপ্রতীপে সমাজ অনেকখানিই ফ্ল্যুয়িড আর সেই কারণেই অ্যাকোমোডেটিভ, মোটের ওপর রবীন্দ্রনাথের ভাবনার মূল সুরটিকে এইভাবে দেখা যেতে পারে। এই মূল সুর ধরতে চাওয়া এবং পারা আমাদের জন্য জরুরি, কারণ যে কোনও বড় মানুষ, থেমে থাকেন না, কাজে এবং ভাবনায়, ভাবনা থেকে কাজে, কাজ থেকে ভাবনায়। সচল মানুষের এই সচলতার কারণেই তার ভাবনার বৈচিত্র্য থাকে, বৈচিত্রকে কখনও বিচিত্রও মনে হয়, কিন্তু অচল মানুষের অচলায়তনের মহড়া সে নেবেই।
রবীন্দ্রনাথের ভাবনাও বহুমাত্রিক, ফলে খণ্ডিত রবীন্দ্রনাথকে, ‘আমাদের লোক’ দাবি করে এমনকি তারাও, যাদের উদ্দেশ্যেই বেশ কতকগুলি ব্যঙ্গ কৌতুক রচনা করেছেন নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ। দিন কয়েক আগেই সুকুমারের নাটকের অংশ উদ্ধৃত করায়, হিন্দুত্ববাদী ভাবাবেগ আহত হয়েছে, এই মর্মে ফেসবুক পোস্টদাতাকে পোস্ট সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে এই রাজ্যের পুলিশ। এইরকম একটা আবর্তে অমিত শাহ রাজ্যে আসছেন পঁচিশে বৈশাখ ‘‘আমার রবীন্দ্রনাথ’’ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে! তাকে জানানো প্রয়োজন- রবীন্দ্রনাথের ব্যঙ্গ কৌতুকের কুশীলব অনেক সময়েই হিন্দুধর্মের প্রধান দেবতা ইন্দ্র।
অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের যা মনে হয়েছে, অর্থাৎ- বিংশ শতাব্দীতে যে গণতান্ত্রিকতার প্রসার ঘটেছে, তার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সায় সম্ভবত ছিল না, তা কিছুদূর সঙ্গতই মনে হয়, কারণ এই গণতন্ত্রের হাত ধরেই ইউরোপে চুড়ান্ত স্টেট পাওয়ারের উত্থান। ইউরোপের বেশিরভাগ ‘উন্নত’ দেশ যখন গণতন্ত্রকে নিজের নাগরিকদের জন্য সুরক্ষিত করছে, তখন তাদের অধিকৃত উপনিবেশগুলিতে মানুষের সাধারণ বেঁচেবর্তে থাকার ব্যবস্থা পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করা হচ্ছিল। ১৯৩০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ মস্কো থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখছেন- ‘‘ভেবে দেখো, নিরন্ন ভারতবর্ষের অন্নে ইংলন্ড পরিপুষ্ট হয়েছে। ইংলন্ডের অনেক লোকেরই মনের ভাব এই যে, ইংলন্ডকে চিরদিন পোষণ করাই ভারতবর্ষের সার্থকতা। ইংলন্ড বড়ো হয়ে উঠে মানবসমাজে বড়ো কাজ করছে, অতএব এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য চিরকালের মতো একটা জাতিকে দাসত্বে বদ্ধ করে রেখে দিলে দোষ নেই। এই জাতি যদি কম খায়, কম পরে, তাতে কী যায় আসে।’’ মনে রাখতে হবে এই চিঠি ১৯৩০ সালে লেখা, মুসোলিনি তখন ইতালির অধিনায়ক, হিটলার জার্মানির। কবি নিজে মুসোলিনির আমন্ত্রণে এবং আতিথ্যে ইতালি ঘুরে এসেছেন ১৯২৬ সালে এবং রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছেন। বেশ অনেকখানি সময় ধরে, এই মুগ্ধতা বজায় থেকেছে। সত্য জানার পরে মোহভঙ্গ হলেও, রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়লাভের আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এবং আজ এই চূড়ান্ত বিজয়লাভ কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে আমাদের কিছুটা দ্বিধায় পড়তে হচ্ছেই, কারণ ইতালিতে এই মুহূর্তে নব্য ফ্যাসিবাদীরা অর্থাৎ মুসোলিনিপন্থীরা ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়াতেই পুনরায় ক্ষমতা দখল করেছে। ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ চন্দ্র বসুকে ‘দেশনায়ক’ অভিধায় অভিহিত করেন। এই দেশনায়কে ‘দেশ’ শব্দটি কি রবীন্দ্রনাথের দেশ সম্পর্কিত ভাবনায় যে ‘স্বদেশ’ শব্দের দ্যোতনা, তাকে মর্যাদা দেয়? এড়িয়ে গিয়ে লাভ নেই, আমাদের কথোপকথন করতে হবে। খণ্ড রবীন্দ্রনাথকে নয়, সমগ্রতায় তাকে গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু সমগ্রে সেই খণ্ডগুলো ‘নেই’ হয়ে যায় না। খণ্ডের উত্তর অখণ্ড নয়। অখণ্ডের উত্তরও খণ্ড নয়। রবীন্দ্রনাথ দেশ বলতে যা বুঝেছেন, তা অমিত শাহদের ‘অখণ্ড’ ভারত নয়। ডাইভার্স ভারত। রবীন্দ্রনাথকে খোলা মনে আমরা পড়তে চাই। রবীন্দ্রনাথকে খোলা মনে আমাদের পড়তে হবে। ব্রেখট লিখেছিলেন- সামান্য ছুঁড়ে দেওয়া সুযোগ সুবিধে নয়, আমাদের চাই গোটা কারখানাটাই। আমাদেরও গোটা রবীন্দ্রনাথ চাই, আস্ত রবীন্দ্রনাথ চাই, ভাইব্র্যান্ট রবীন্দ্রনাথ চাই।
Post Editorial Rabindranath Thakur
আমাদের চাই আস্ত রবীন্দ্রনাথকেই
×
Comments :0