এক বিকেল, সলিল আর আমি
অয়ন মুখোপাধ্যায়
শরতের কলকাতা। আকাশে তুলোর মতো মেঘ, সূর্যের আলো যেন কাঁচের জানালায় আটকে গিয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের গলিপথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল শহরটা আসলে এক সিম্ফনি। বইয়ের দোকানের পাতা উল্টোনোর শব্দ, চায়ের কাপে চামচের ঠকঠক, দূরে রিকশার ঘণ্টা—সব মিলে যেন অচেনা অথচ চেনা এক সুর। আমি একা বসেছিলাম কফিহাউসের ভেতর, টেবিলে খোলা নোটবই, কিন্তু কলম থেমে আছে। লিখতে পারছিলাম না কিছুই।
ঠিক তখনই ঘটল বিস্ময়। পাশের টেবিল থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত সুর। প্রথমে ভেবেছিলাম কেউ হয়তো পুরোনো গান গুনগুন করছে। কিন্তু চোখ তুলে তাকাতেই শরীর শিউরে উঠল।
সলিল চৌধুরী।
হ্যাঁ, তিনিই।
কোথা থেকে এলেন, কীভাবে এলেন—জানি না। ধূসর কোট গায়ে, চোখে দুষ্টু আলো, ঠোঁটে হাসি—যেন কালের প্রাচীর ভেঙে চলে এসেছেন আমার পাশে।
তিনি হেসে বললেন,
“এই শহরের শব্দগুলো বদলে গেছে, বুঝলে? একসময় ট্রামের ঝমঝম শব্দে আমি গান বানাতাম, এখন হলে বানাতাম মেট্রোর আওয়াজে। ওই যে ট্রেন ছাড়ার আগে যে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল বাজে, সেটা দারুণ রিদম। একটু বদলালেই গান তৈরি।”
আমি নির্বাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু আজকের মানুষ কি এসব শুনতে চাইবে?”
তিনি হেসে উঠলেন।
“মানুষ সবসময় একই থাকে। খিদে তার একই রকম, ভালোবাসা একই রকম, স্বপ্নও তাই। শুধু সাউন্ড পাল্টায়, গল্প পাল্টায় না। গান মানে তো গল্প, প্রতিটি শব্দের ভেতরেই গল্প লুকিয়ে থাকে।”
কফিহাউসের ভেতর আলো ঝিমিয়ে এল। চারপাশের কথাবার্তার গুঞ্জন মিলিয়ে গিয়ে ভেসে উঠল অদ্ভুত সব শব্দ—মিলের সাইরেন, ট্রামের ঘণ্টা, রাস্তায় প্রতিবাদমিছিল। মনে হলো তিনি এই শব্দগুলো টেনে এনে মিশিয়ে দিচ্ছেন সুরে। তাঁর ঠোঁট থেকে ফিসফিস করে বেরোল—“ও আলোর পথযাত্রী…” সেই তিন শব্দে যেন থেমে গেল চারপাশ। তরুণরা কফি ফেলে তাকিয়ে আছে, ওয়েটারের ট্রে মাঝআকাশে থমকে গেল।
আমি বললাম, “আপনার গল্প আমরা ভুলেই গেছি। সবাই আপনাকে গান দিয়ে মনে রেখেছে।”
সলিলের চোখে হঠাৎ ছায়া নেমে এলো।
“আমি তো আসলে গল্পকারই ছিলাম। গ্রামের খেতে-খামারে, কৃষকের মুখে তার খিদের গল্প শুনতাম। সেই গল্প লিখতাম। পরে গান হয়ে গেল, সিনেমা হয়ে গেল। কিন্তু মূলে ছিল গল্প। মানুষ আমাকে গায়ক বানাল, সুরকার বানাল, কিন্তু আমার ভেতরের গল্পকারকে ভুলে গেল।”
বাইরে তখন হঠাৎ মিছিল এল। কলেজ স্ট্রিটের ওপর দিয়ে ভেসে এল স্লোগান—“কাজ চাই, অধিকার চাই।”
সলিল জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখে আবার ঝিলিক।
“শোনো, এই স্লোগানগুলোই তো গান। আমি একসময় এইসব স্লোগান শুনতাম, পরে সেটা গান হয়ে যেত। মানুষের দাবি যতদিন থাকবে, গানও ততদিন বেঁচে থাকবে।”
আমি সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি যদি সত্যিই আজকের দিনে থাকতেন, কী লিখতেন?”
তিনি হেসে ফেললেন।
“লিখতাম ডিজিটাল দুনিয়ার একাকিত্বের গল্প। ইন্টারনেটের ঝড়ের ভেতর হারিয়ে যাওয়া প্রেমকাহিনি। মোবাইলের রিংটোন, হোয়াটসঅ্যাপের পিং, মেট্রোর আওয়াজ—সব মিলিয়ে নতুন গান বানাতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান মানে মানুষের লড়াই। খিদে আর স্বপ্ন—এই টানাপোড়েন ছাড়া কোনও গান জন্মায় না।”
হঠাৎ তিনি পকেট থেকে একটা ছেঁড়া নোটবই বার করলেন। পাতায় কেবল অর্ধেক লেখা কয়েকটা লাইন। সেটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,
“এই লাইনগুলো শেষ করে দিও। গল্প কখনো শেষ হয় না, কেবল অন্যের হাতে গেয়ে ওঠে।”
আমি কাগজে তাকালাম—লেখা আছে মাত্র দুটো লাইনঃ
“রাস্তার শব্দে লুকিয়ে আছে মানুষের ইতিহাস,
শোনো, প্রতিটি আওয়াজেই লুকিয়ে আছে বিপ্লব।”
কথা শেষ করেই তিনি যেন মিলিয়ে গেলেন। কফিহাউসের আলো আবার ঝলমল করে উঠল, ওয়েটার এসে চা রাখল, পাশের টেবিলে কোলাহল ফিরে এল। কিন্তু টেবিলে পড়ে রইল সেই কাগজ।
আমি আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম, শব্দগুলো কাগজ থেকে উঠে আসছে, যেন সুর হয়ে বাজছে কানে। বাইরের মেট্রোর আওয়াজে হঠাৎ মনে হলো ঢোল বাজছে, গাড়ির হর্ন মিলেমিশে গিটার হচ্ছে, ভিড়ের চিৎকার ভেসে আসছে কোরাসে। শহরের প্রতিটি শব্দ গান হয়ে উঠছে।
তখনই বুঝলাম, সলিল আসলে কোথাও যাননি। তিনি রয়ে গেছেন এই শহরের শব্দে, আমাদের চারপাশের প্রতিটি আওয়াজে। আমরা ভুলে যাই, কিন্তু তাঁর গল্প বেঁচে থাকে—হয়তো স্লোগানে, হয়তো মেট্রোর গর্জনে, হয়তো আমাদেরই অসমাপ্ত লেখার ভেতরে।
আমি কলম হাতে নিলাম। নোটবইয়ের ফাঁকা পাতায় লিখতে শুরু করলাম সেই অসমাপ্ত লাইন। মনে হচ্ছিল, সলিল কানে কানে বলে যাচ্ছেন—
“গল্প শুধু বইতে নয়, প্রতিটি শব্দেই আছে গল্প। শোনো, প্রতিটি সুরেই লুকিয়ে আছে মানুষের বেঁচে থাকার ইতিহাস।”
Comments :0