salvador allende

১ মিনিটের অন্ধকার অন্ধ করতে পারবে না

আন্তর্জাতিক

সমুদ্র গুহ

১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩, সকাল ৬.২০। চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর টমাস মোরো স্ট্রিটের রাষ্ট্রপতির নিজস্ব বাড়িতে টেলিফোনটা বেজে উঠতেই তুলে নিলেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আলেন্দে।... সামরিক ক্যুদেতা হয়েছে। মিলিটারিরা সব পজিশন নিচ্ছে।দ্রুত ছেড়ে দিলেন ফোন। মাথায় পরে নিলেন ক্র্যাশ হেলমেট। সহযোদ্ধাদের জানিয়ে দিলেন। ছুটে চলেছেন রাষ্ট্রপতি ভবন লা মনেদা প্রাসাদের দিকে। যেকোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে চিলির সংবিধান, নির্বাচিত সরকার এবং চিলির খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার। ঠিক সাড়ে সাতটায় ঢুকে গেলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। নির্দেশ দিলেনএ যুদ্ধে যারা থাকতে চান আমাদের সাথে তারা থাকবেন। যারা চান না চলে যাবেন। সিদ্ধান্ত আপনার, গণতন্ত্র সবার জন্য।

সকাল ৮.১৫।

সামরিক জুন্টা দাবি করল রাষ্ট্রপতি আলেন্দে তাঁর পরিবার সহ দেশ ছেড়ে চলে যান, নিরাপদে ছেড়ে দেবো। সরকারকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। উত্তর এল রাষ্ট্রপতি ভবনের জানলা দিয়ে। সশব্দ গুলির জবাব।

একদিকে মাপোচা নদীর সেতু পার হয়ে এগিয়ে আসছে সাঁজোয়া গাড়ি। ফরেস্টাল পার্কে ট্যাঙ্কের সারি, কামানের মুখ ঘোরাচ্ছে। দূরবীণে কালো চশমা পরে দেখছে ষড়যন্ত্রের নায়ক জেনারেল পিনোচেত। অন্যদিকে শেষবার চায়ে চুমুক দিয়ে সাংবাদিকদের চিলির গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ের ব্যাখ্যা করে ছুটে গেলেন আলেন্দে লাইট মেশিনগানের দিকে। ট্রিগার অন করে দিলেন। মাথা নিচু করে নেমে গেল বিশ্বাসঘাতকের দঙ্গল। একটা ট্যাঙ্ক জ্বলছে, বাজুকার গোলাতে ধ্বংস। প্রতিটি জানলায় উদ্ধত বন্দুক। অন্তিম যুদ্ধ লড়ছে চিলির মানুষের ভোটে নির্বাচিত, জয়ী, পপুলার ইউনিটি সরকার।

 কে এই ডঃ সালভাদোর আলেন্দে? জানতেন ক্যামিলো, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা। মেক্সিকোতে আত্মগোপনে থাকা কিউবান বিপ্লবীদের সাথে সম্ভাব্য বিপ্লবের রূপরেখা তৈরি থেকে রসদ সব কিছুতে হাত লাগিয়েছেন একজন চিলির বিপ্লবীডঃ সালভাদোর।

চিনতো লোতো, সেয়োগার তামার খনির মজুররা। যে খনির সুড়ঙ্গ নেমে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে। দড়িয়ার অশান্ত লোনা সমুদ্রের জল মাঝেমধ্যেই দাপিয়ে বেড়ায় খনির ভিতরে। পোসপানিওয়ালাদের বুক প্রফিটে লেখা থাকে না নিঃসঙ্গ বালিয়ারিতে নিহত মজুরের কথা। ১৯৫৮ সালে হয়েছিল সুবিখ্যাত কয়লা-তামার খনির মজদুরের মিছিল। ১৯৭০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চিলির সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয় প্যপুলার ইউনিট ফ্রন্ট। কমিউনিস্ট-সোশালিস্ট, মেহনতি মানুষের রায়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আলেন্দে প্রথমেই চিলির খনির জাতীয়করণ করলেন। আমেরিকার তামার বহুজাতিক কোম্পানি অ্যানাকোন্ডারসর্পউদ্যানে হিসহিস বন্ধ। চেরা জিভ, লকলক করছে, ফ্যালফ্যাল করে দেখল তাদের প্রিয় ডলার সাম্রাজ্যবাদের শক্ত ভিত হেলেকেঁপে বসে যাচ্ছে।

বুঝতো চিলির সান ফার্নান্দো উপত্যকার বিস্তীর্ণ কৃষি অঞ্চল। সেখানকার কৃষকরা সূদুর অতীত থেকে ছিল দাস। সমগ্র এলাকাটা ছিল জমিদার-সামন্তপ্রভুদের হাতের মুঠোর রুমাল। ব্যাপক কৃষক ধর্মঘট শুরু হয়েছিল আগেকার খ্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক সরকার, ওদের নেতা এদোয়ার্দো ফ্রের বিরুদ্ধে। এই ধর্মঘটে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন আলেন্দে। ক্ষমতায় এসেই জমিদারদের মাত্রাতিরিক্ত সুবিধাগুলো ছেঁটে দিলেন আর দিলেন চিলি নামক দেশটার সরকারের নাগরিক স্বীকৃতি যাতে তারা সমস্ত সরকারি সুবিধাগুলো পায়। যা তারা পায়নি ১৮১০ সালের চিলির স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কাল থেকে।

কনসেপসিওন। সত্তরের দশকের দুর্বার আন্দোলনের জন্ম। শিক্ষাকে বিনামূল্যে দিতে হবে। দিতেই হবে। এই ছাত্র আন্দোলনের সামনে দাঁড়ানো সৌম্যদর্শন মানুষটার নাম ডঃ সালভাদোর আলেন্দে। ৭০ সালের সে নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন আলেন্দে। সেবার তিনি জেতার ব্যবধান বাড়াতে পেরেছিলেন এই কনসেপসিওনে।

কিন্তু অনেক কিন্তু আছে। পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি ভিদেলা ১৯৪৬ সালে শুরু করে ভয়াবহ দমন-পীড়ন। তৈরি হয় অতি কুখ্যাত ‘‘পিসাগুয়া’’ বন্দি শিবির। সেই শিবিরে তৈরি হলো ১১ সেপ্টেম্বরের গণহত্যার বর্বরতার ষড়যন্ত্র। ফ্যাসিস্ত ডিকটেটর জেনারেল অগাস্তো পিনোচেত। যার সাথে হাত মেলালো চিলির নির্বাচনে পরাজিত দক্ষিণপন্থী খ্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি।

মিলিটারি আক্রমণ শুরু করেছিল দুদিক থেকে। বুলনেস প্লাজা আলমেডা আর দ্য লা কয়মটিটসন প্লাজা। আসলে আক্রমণ, অন্তর্ঘাত, গোপন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল অনেক দিন আগে থেকেই। পপুলার সরকার বামপন্থী চিন্তা-চেতনার সরকার। ব্যাঙ্ক-খনি জাতীয়করণ করেছে। ৩০০র বেশি বিদেশি কোম্পানিকে দেশছাড়া করেছে। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করার সবদিক থেকে চেষ্টা চালাচ্ছে। কিউবা হাতছাড়া। শত শত বছর ধরে লাতিন আমেরিকার ক্রীতদাস বিক্রির সেরা বাজার হাভানায় উড়ছে লাল ঝান্ডা। চিলিও চলে যাচ্ছে। দ্রুত তৈরি হলো প্রতিবিপ্লব।

চিলির সরকারের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য যত বৈদেশিক ঋণের আবেদন করা হয়েছিল সব বাতিল হতে লাগল। চিলির সবথেকে দামি খনিজ সম্পদ হচ্ছে তামা। হঠাৎ বিশ্ববাজারে তামার দাম পড়ে যেতে লাগল। ডলারের তুলনায় দাম কমছে চিলির মুদ্রা পেসোর। কলকাঠি নড়তে শুরু করেছে শীতপ্রাসাদ থেকে।

নানান রুক্ষ দাবি নিয়ে শুরু হলো গাড়ি মালিকদের ধর্মঘট। দেশের বুকে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে লাগল। দুধ-রুটি সব অমিল। কৃষকরা নিজেরাই যৌথ সমবায় পদ্ধতিতে চাষ করবেন ঠিক করলেন। কিন্তু সার থেকে কীটনাশক কিছুই এসে পৌঁছাচ্ছে না। অগ্নিমূল্য হতে শুরু করল জিনিসের দাম। পরিকল্পনা মাফিক হাঁটতে শুরু করেছে প্রতিবিপ্লবীরা। ঐ মজদুরদের দাপটটাকে খতম করতেই হবে। কারণ চিলির শ্রমিকরা একটার পর একটা কারখানায় মালিকের পরাক্রমকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে, ধান্দাবাজ মুনাফাখোর ম্যানেজমেন্টকে লাইনের বাইরে ঠেলে দিয়ে তৈরি করেছে ফ্যাক্টরি কাউন্সিল। এতো সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা রাজপথ তৈরি হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের কূল থেকে বিয়াও বিয়াও নদীতীর হয়ে সান্তিয়াগোর রাজপথে। অতএব একে ধ্বংস কর। একটার পর একটা সঙ্কট তৈরি হোক চিলিতে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে ঐ আলেন্দের সরকার।

কিন্তু না, প্রতিবাদে প্রতিরোধে লক্ষ মানুষ শামিল। এসব হাঁটে হাটুরে জনপদের হাঁটাচলাকে বেপথু করতে সক্রিয় হলো মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদ। ডাক্তার থেকে অধ্যাপক সব হাসপাতাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বয়কট করতে শুরু করলেন। ওনারা নাকি হাঁপিয়ে উঠেছেন। শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিষেবা ভয়ঙ্কর অবস্থা নিলো। ছাত্ররা না হয় ঘেরাও করল কিন্তু ডাক্তারদের বিকল্প হবে কে? অচলায়তনে পরিণত করার দাবার ছক মিলিটারি ব্যারাকগুলোতে কাজ শুরু করল। মনে রাখবেন তৎকালীন চিলির সমর বিভাগের বেশিরভাগই শিক্ষিত আমেরিকায়। যারা এর বিরুদ্ধে তাদেরকে সরিয়ে দাও। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে নির্বাচনে জিতলেন আলেন্দে। ঠিক একমাস বাদে অক্টোবরে খুন হলেন চিলির সামরিক বাহিনীর প্রধান রেনে স্নেইডার। কারণ উনি চেয়েছিলেন চিলির সার্বিক উন্নতি এবং ওয়াশিংটনের মন্ত্রগুপ্তির থেকে মুক্তি।

আজ থেকে ৫০ বছর আগে ছিল না মোবাইলে ছবি তোলার ব্যবস্থা। কিন্তু রক্তাক্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত রাজধানী সা‍ন্তি‌য়াগোর খবর সারা পৃথিবীর হেডলাইন হয়ে গিয়েছিল। আকাশ থেকে ফেলা বোমার আগুনে জ্বলছে মনেদা প্রাসাদ। কারবাইনের গুলিতে ছিন্নভিন্ন চিলির রাষ্ট্রপতি ডঃ সালভাদোর আলেন্দের শরীর। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জানলা-দরজা-সিঁড়ি সর্বত্র। পুড়ে যাচ্ছে শেষ যুদ্ধের কমরেডদের শরীর। যাদের শেষ কথা ছিল একটাইআমরা আত্মসমর্পণ করব না।

হিমশীতল এক মৃত্যু পরোয়ানা এসে হাজির হলো। কত যে খুন হয়েছিল তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। সান্তিয়াগো স্টেডিয়াম হয়ে গিয়েছিলো জহ্লাদের বধ্যভূমি। হাজার হাজার মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে খুন করা হয়েছে। মালোচা নদীর জলে ভাসছিলো অসংখ্য ক্ষতবিক্ষত লাশ। দাওমঙ দ্বীপের নরকে নিয়ে যাওয়া হয় অজস্র বন্দিদের। যাদের আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। অসংখ্য ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের নির্বিচারে খতম করা হয়। প্রতিভাবান কবি ভিকটর জারা থেকে গায়ক পাবলো মিলোনাস, ভায়োলেতা পারা হয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক লুই কোরভালান ও হিলিনস, গ্যাব্রিয়েল মিসত্রাল কে নেই। কেউ খুন, কেউ যাবজ্জীবন বন্দি। ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে রেডিও স্টেশন মৃতদেহের স্তূপ। মুহূর্তের মধ্যে দশ-বিশ হাজার চিলির মানুষ নির্বাসিত। রাস্তায় পোড়ানো হচ্ছে বই। লস ক্যারিলস এয়ারপোর্ট থেকে রেলস্টেশন; হাতে তালিকা নিয়ে ঘুরছে ঘাতকবাহিনী। গুপ্তচর আর গুপ্তঘাতকে চারিদিক ছয়লাপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইনস্ট্যান্ট ডেথ স্কোয়াড, কারফিউ, কাঁটাতার, কফিন, মর্গের মালিক পিনোচেতের একটা কথা চারিদিকে ছড়িয়ে যায়— ‘‘যখন সত্যি কথাও বলছে তখনও কোনও মহিলাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো না’’। লোকটা নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করত না। যেসব মিলিটারিদের সাহায্যে সফল ক্যুদেতা করে ক্ষমতায় বসেছিলেন তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলক অবসরগ্রহণ করিয়ে‍‌ছিলেন। কারণ ইতিহাসকে বড় ভয়। বিধ্বস্ত মনেদা প্রাসাদকে নতুন করে গড়ে তুলেছিল যাতে অজস্র সুড়ঙ্গপথ, গোপন দরজা, মোটরগাড়ি থেকে আমডি কার রাখার ব্যবস্থা আর ছাদে হেলিপ্যাড তৈরি যাতে চট করে পালিয়ে যাওয়া যায়। কারণ বেআইনি ইনসিলাব তৈরি হচ্ছে আনাচে কানাচে। গরম বুলেট যদি ঠান্ডা কপাল ফুটো করে দেয়।

১১ সেপ্টেম্বরের ঠিক ১২দিন বাদে চলে গেলেন চিলির জাতীয় কবি, সারা পৃথিবীর কবিতার মলোটভ ককটেল, যি‍‌নি চিনিয়েছিলেন সান ক্রিন্তোবাল পাহাড় থে‍‌কে ভালপারাইসো সেই মানুষের হৃদয়ের পাবলো নেরুদা।

সান্তিয়াগোর ক্যালে মারদোয়েজ দ্য লা প্লাতার বাড়িতে কফিনে শায়িত কবি। বাড়ির চারিদিক ঘিরে ফ্যাসিস্ত পুলিশ-মিলিটারি। ভালপারাইসো থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণে সান আন্তোনিও সড়কের কাছে ইসলা নেগরাতে নেরুদার পুরান বাড়ি কাঠের তক্তা দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মরণবিজয়ী মানুষ তাতে লিখে দিয়েছিল অমর এক লাইন— ‘‘১ মিনিটের অন্ধকার আমাদের অন্ধ করতে পারে না।’’ মিলিটারি কার্ফুর নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে ২ হাজার মানুষ হেঁটেছিল সেদিন শেষযাত্রায়। লাল গোলাপে নিথর পাবলো নেরুদার শরীর ঘিরে কমরেডদের স্লোগান। কমরেড পাবলো নেরুদা, সালভাদোর আলেন্দে তোমায় জানাই লাল সেলাম। ডঃ সালভাদোর আলেন্দের শেষ সময়ে কেউ হাঁটতে পারেনি যে।

এরপর কী হলো? ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শেষ হতে না হতেই চিলির অর্থনীতির দায়িত্ব নিতে ঝটিকা সফরে ছুটে এল শিকাগো অর্থনীতিবিদরা। কে তারা? আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন নতুন নাকি পুরানো মদ নতুন বোতলে ঢালা দুই অর্থনীতিবিদের জয়জয়কার। প্রথমজন মিলটন ফ্রিডম্যান। দ্বিতীয়জন আর্নল্ড হারবাগরি। পন্টিফিকাল ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়। চিলির এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালগের অনুমোদনপ্রাপ্ত। রাস্তা খুলে গেছে। ঐ দুই অবতারের ছাত্ররা রক্ত শোঁকা পিনোচেতের সরকারের অর্থনীতি মন্ত্রকের দায়িত্ব নিল। লাতিন আমেরিকার বুকে নয়া উদার অর্থনীতির সূচনা হলো চিলির মাটিতে।

বাজার অর্থনীতির উন্মত্ত লালসায় যা কিছু জাতীয়করণ করা হয়েছিল সবকিছুর বেসরকারীকরণ করা হলো। বাজারকে ঈশ্বর জ্ঞান করে মানুষের শ্রম ও মেধাকে চুলোর দোরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সারা বিশ্ব শুনলো একটা নতুন শব্দ। ফ্রিয়েড ম্যা নইট হায়াকিজরা’’। মাত্র ৩-৪ বছরে বেকারিত্বর হার চরমে পৌঁছলো, দারিদ্র সীমার নিচে তলিয়ে গেল বেশিরভাগ মানুষ। ক্রয়ক্ষমতা আর বেঁচে থাকার শেষ সীমার মধ্যে তফাত মাত্র এক বুলেট। মাত্র ১ বছরে বৈদেশিক ঋণ দাঁড়ালো ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। অনেক বুর্জোয়া দেশ এমনকি আমেরিকারও বহু মানুষ চিলির বুকে জবরদস্তি জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন রাস্তা থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘে। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘ আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করল। তৎকালীন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন কুর্ট ভাল্ডাইম। যিনি পরবর্তীকালে ধরা পড়েন হিটলারের নাৎসি পার্টির এক প্রধান হিসাবে যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রিস ও যুগোশ্লাভিয়াতে ফ্যাসিস্ত বর্বরতার অন্যতম নেতা ছিলেন। গণহত্যার এক দোসর আরেকজনকে মদত তো দেবেই।

সাম্রাজ্যবাদের এই রক্তজমাট অভিযান সফল হয়েছিল তার আগে ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়াতে। সেদিনও মার্কিন মদতপুষ্ট এক জেনারেল সুহার্তো সামরিক বেআইনি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কমিউনিস্ট খতম অভিযান চালিয়ে লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্ট সহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা প্রণালি সেপে চিলির ম্যানেল্লান প্রণালিতে একই ষড়যন্ত্রের ফ্যাসিস্ত প্রকাশ, সমুদ্রের জল ভারী হয়ে গেছে ঘন রক্ত স্রোতে।

৫০ বছর বাদে চিলিতে এখন সামরিক জুন্টার সরকারি দাপট নেই। রাষ্ট্রপতি এখন বামপন্থী ছাত্রনেতা গ্যাব্রিয়েল বোরিক। চিলিতে গোপনে ছদ্মবেশ নিয়ে সিনেমা করতে আসতে হয় না মিগুয়েল লিতিনকে। এক কাপড়ে দেশ ছাড়তে হয় না কলম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গার্সিয়া মার্কেজ, ব্রাজিলের নাট্য পরিচালক অন্তানো বোয়াল, চিলির নাট্যকার এরিয়েল ডর্ফম্যানকে। দিনবদল হচ্ছে। রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না সন্দেহের কেউ। মোতায়েন নেই মেশিনগানের মুখ। লাতিন আমেরিকায় এখন উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে তাজা হাওয়ার মতো সশব্দ বামপন্থী নয়া ভাবনা। সোভিয়েত উত্তর পৃথিবীতে নয়া ভাবনার রসদ জোগান দিচ্ছে লাতিন আমেরিকা।

বিশ্ববীক্ষার নতুন সময়ে অবশ্যই মনে রাখা দরকারফিকির খুঁজছে প্রতিবিপ্লব। কারণ পুঁজিবাদের মৌতাত ফুরিয়ে যায়নি। পি‍নোচেত, সুহার্তো, মোবুতু, ভিদেলা, ম্যাকনামারার মতো বর্বররা আপাতত আঁস্তাকুড়ে হারিয়ে গেলেওআস্তাকুঁড়টাকেই বাতিল করা দরকার। নয়তো পুঁজিবাদের খোয়াব থেকে তৈরি হবেই আরেক অবতার। যেন ভুলে না যাইসালভাদোর আলেন্দে সহ কমরেডদের রক্তের দাগ এখনও টাটকা আছে। ৫০ বছরেও শু‍‌কোয়নি।

Comments :0

Login to leave a comment