Sitaram Yeachury

সিবিআই তদন্ত কেন? সন্দিহান ইয়েচুরি, খাড়গে

জাতীয়

বালেশ্বরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার তদন্তভার সিবিআই’র হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কি কেবলমাত্র নজর ঘোরানোর জন্য? প্রশ্ন উঠেছে, রেলওয়ে সুরক্ষা, সিগনাল ব্যবস্থা, রেলের রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতির প্রযুক্তি সম্পর্কে যে সংস্থার কোনও জ্ঞান নেই, তাদেরই কেন তদন্ত করতে বলছে মোদী সরকার? বালেশ্বর দুর্ঘটনার সিবিআই তদন্ত নিয়ে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের ঘোষণার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সোমবার এব্যাপারে আলাদা আলাদাভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলে এই দুর্ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছেন তাঁরা।
এদিন এক ভিডিও-বার্তায় সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, সিবিআই তদন্ত হয় ফৌজদারি মামলায়। কিন্তু রেলের সুরক্ষা বিশেষত যাত্রী সুরক্ষার ক্ষেত্রে কি ঘাটতি আছে বা ত্রুটি আছে, তা কিভাবে দূর করতে হবে, সেটা নিয়ে দেশের মানুষের যে দুশ্চিন্তা রয়েছে তার থেকে নজর সরানোর চেষ্টা হলে তা বিরাট বিপদ হবে। দেশের মানুষের জন্য রেলওয়ে একটি জীবনধারা। বিশেষত দেশের গরিব মানুষের জন্য। রেলের ৩ লক্ষ ১২ হাজার পদ এখনও খালি আছে। সরকার সেই পদগুলিতে নিয়োগ করেনি। এই শূন্যপদের বড় অংশ হচ্ছে নন-গেজেটেড পদ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় গ্যাঙম্যানের পদ খালি আছে। রেললাইন নিরন্তর পরীক্ষা করে চলেন গ্যাঙম্যানরা। অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যদি পদ খালি পড়ে থাকে, তা রেলের সুরক্ষার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। 
ইয়েচুরি মনে করিয়ে দিয়েছেন, মোদী সরকার আসার পরে ২০১৭ সালে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। টাস্ক ফোর্স জানায়, রেলের ট্র্যাক বদলানোর কাজে গুরুতর ঘাটতি আছে। অতি দ্রুত এই কাজ করতে হবে। এই রিপোর্ট আসার পরেও দেখা গেল, ২০২২ সালের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ১৪ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হলো! অর্থাৎ রেল সুরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপ করার ছিল, সেই কাজ হয়নি। দুর্ঘটনার দু’দিন আগে ৩১ মে ‘দ্য হিন্দু’ তে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখানো হয় রেলের সুরক্ষার ক্ষেত্রে কি কি ঘাটতি আছে। দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে এবং রেলওয়ের স্বার্থে এসব কিছুর সংশোধন করা প্রয়োজন। এখন সিবিআই তদন্তের অজুহাতে যদি এসব ঘাটতি ফের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়, তাহলে আগামী দিনে তার ফল মারাত্মক হবে, বলেছেন ইয়েচুরি। 
ইয়েচুরি বলেন, এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। আইনিভাবে, সাংবিধানিকভাবে রেলের প্রতিটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্ত করতে হয় রেলের সেফটি কমিশনারকে। রেল সুরক্ষা কমিশনের সেই তদন্তই শেষ হয়নি। তার আগেই যদি সরকার সিবিআই তদন্তের কথা বলে দেয়, তাহলে ওই তদন্তও অসম্পূর্ণ থাকবে। এটি দেশের পক্ষে ভালো হবে না। তাই প্রকৃত ঘটনা থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা না করার জন্য মোদী সরকারকে সতর্ক করছে সিপিআই (এম)। বরং সঠিক তদন্ত করে রেলের যাবতীয় ত্রুটি ও দ্রুত সংশোধন করা উচিত। 
এদিকে বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনার সিবিআই তদন্ত নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সোমবারই বলেন, এই সংস্থা তো বিভিন্ন অপরাধের তদন্ত করে! রেল দুর্ঘটনার তদন্ত করা সিবিআই’র কাজ নয়। কোনও রেল দুর্ঘটনার পিছনে প্রযুক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিরূপণ করাও সিবিআই’র পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চার পৃষ্ঠার চিঠি লিখে খাড়গে বলেন, দেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম রেল দুর্ঘটনাগুলির অন্যতম দুর্ঘটনা ঘটেছে বালেশ্বরে। রেল ও রেলযাত্রীদের সুরক্ষার ব্যাপারে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সব আশ্বাসই এখন ‘ফাঁকা আওয়াজ’ বলে প্রমাণিত হয়েছে। রেল সুরক্ষায় ধারাবাহিক অবনমনে সাধারণ যাত্রীরা এখন রীতিমতো আতঙ্কিত বোধ করছেন। ফলে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার পেছনে আসল সত্যিটা কি, তা জনসমক্ষে আনতে হবে সরকারকে।
খাড়গে একসময়ে রেলমন্ত্রীও ছিলেন। তিনি বলেন, একেবারে গোড়া থেকে রেলওয়েকে জোরদার করার বদলে সরকার শুধু খবরে থাকার জন্য ওপর ওপর কিছু প্রসাধনী পদক্ষেপ নিচ্ছে। মোদী আমলে রেলের প্রতি বিমাতৃসুলভ ব্যবহার করা হচ্ছে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে রেলযাত্রাকে ক্রমাগত অসুরক্ষিত ও বিপজ্জনক করে তোলা হচ্ছে। আর এর ফলে দেশের মানুষের ভোগান্তি জটিলতর হয়ে উঠছে। এরপরেই খাড়গে মোদীকে লিখেছেন, ‘‘দুঃখজনকভাবে আপনার পছন্দের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব কোন সমস্যাই স্বীকার করতে চান না।’’
খাড়গের কটাক্ষ, বালেশ্বরে দুর্ঘটনার ‘‘আসল কারণ ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে’’ বলে দাবি করলেন রেলমন্ত্রী। তারপরেই আবার সিবিআই তদন্তের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন! সিবিআই তদন্তের কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রীকে খাড়গে লিখেছেন, সিবিআই’র মতো সংস্থাগুলি বিভিন্ন অপরাধের তদন্ত করে। কোনও রেল দুর্ঘটনার পেছনে প্রযুক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা নির্দিষ্ট করা সিবিআই’র পক্ষে সম্ভব নয়। রেলওয়ে সুরক্ষা, সিগনাল ব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতির প্রযুক্তি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে সিবিআই’র।
মোদী সরকারের অতীত কীর্তি মনে করিয়ে দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাষায় খাড়গে লিখেছেন, ‘‘২০১৬ সালে কানপুরের রেল দুর্ঘটনার কথা দেশ ভুলে যায়নি। সেবার ১৫০জন রেলযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ)’র হাতে তদন্তভার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী। আপনি নিজেও ২০১৭ সালে এক নির্বাচনী জনসভায় এই দুর্ঘটনার পেছনে ‘ষড়যন্ত্র’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। দোষীদের ‘কঠোর শাস্তি হবে’ বলে শুনিয়েছিলেন দেশবাসীকে। এত কিছুর পরে ২০১৮ সালে তদন্তই বন্ধ করে দিল এনআইএ! এমনকি তারা চার্জশিট দিতেও অস্বীকার করল! কিন্তু কাদের কারণে সেই ১৫০ জন রেলযাত্রীর অসহায় মৃত্যু হলো, তা দেশবাসীর কাছে অজানাই থেকে গেল! এবার ফের বালেশ্বর দুর্ঘটনার তদন্ত প্রযুক্তিগত দক্ষতাহীন আরেকটির সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমাদের ২০১৬ সালের কথা মনে পড়ছে।’’ 
খাড়গে স্পষ্ট বলেছেন, আমাদের রেলযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই মুহূর্তে সব রেলপথে বাধ্যতামূলকভাবে এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সুরক্ষা বিধি কার্যকরী করতে হবে। এজন্য যথাযথ বরাদ্দ, রেলের ৩লক্ষ শূন্যপদ পূরণ করে চালক সহ রেলকর্মীদের কাজের অস্বাভাবিক চাপ কমানোর মতো পদক্ষেপ করতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment