Post Editorial Agricultural Workers

খেতমজুরের জীবনযন্ত্রণা নিয়ে এই নাটক কেন?

রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

অমিয় পাত্র

সম্প্রতি দিল্লির রাজঘাট, কৃষি ভবন, যন্তর মন্তর এবং কলকাতার রাজভবনের সামনে যে নাটক আমরা দেখলাম তা আদৌ ১০০ দিনের কাজের জন্য কেন্দ্রীয়  বরাদ্দ  আদায়ের লড়াই নয়। গ্রামীণ মজুরদের জীবন যন্ত্রণার কথা যারা উপলব্ধি করেন  তারা কি কখনো এই মজু্রদের হকের টাকা লুট করতে পারেন? এই আন্দোলনে যাদের দেখা যাচ্ছে তারাই তো লুটের টাকার ভুক্তভোগী।  মূলত তিনটি কারণে এই হুল্লোড়বাজির আয়োজন। এক - তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি দলের মধ্যে সেটিং বা গোপন বোঝাপড়া ক্রমেই জনমানসে বিশ্বাসগ্রাহ্য হয়ে উঠছে। সম্প্রতি রাজ্যের দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগগুলি তদন্তের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা থেকে স্পষ্ট হয়েছে দুই দলের মাথায় মাথায় বোঝাপড়া আছে। এই বোঝাপড়া চলতে থাকলে এ রাজ্যের দুর্নীতির কোনও  কিনারা হওয়া সম্ভব নয়। এই সত্যটা চাপা দিতেই  দুই দলের মধ্যে মেকি লড়াই তীব্র করার প্রয়োজন হয়েছে। দুই- এটা একটা প্রজেক্ট যার মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেসের কচি নেতাকে জাতীয় নেতা হিসাবে উন্নীত করার চেষ্টা হয়েছে। এটা লক্ষণীয় অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে তৃণমূল পোষিত মিডিয়াকুলের ক্যামেরার ফোকাসে একজনকেই দেখা গেছে। তিলকে তাল বানানো প্রজেক্ট।  তিন- বিপুল অর্থ, পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে যে অন্যায়ভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে তা দলের মধ্যেও গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে ক্ষয় নিরাময়ের থেরাপি  হলো এই মেকি আন্দোলন। অনেকে মনে করেন আরও একটা কারণ আছে। সেটা হলো কচি নেতার পার্শ্বচরদের করে খাওয়ার সুযোগ  কিছুটা সঙ্কুচিত হয়েছে তাই তাদের কথা বিবেচনায় রেখে নেতার অভিষেক এবং অনুচরদের অভিলাষ পুরণে ১০০ দিনের কাজের টাকার কোনও বিকল্প হয় না। 

২০০৬ সাল থেকে রেগা  বা ১০০ দিনের কাজ  দেশের ৬২৫ টি জেলায় শুরু হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে দেশের সমস্ত জেলায় এই কাজ সম্প্রসারিত হয়েছে।  পশ্চিম বাংলা ছাড়া এ পর্যন্ত কোনও রাজ্যের জন্য রেগার  অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়নি। এই প্রথম একটি রাজ্যের বরাদ্দ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বন্ধ হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কেন বন্ধ হলো?  রাজ্য সরকার ও শাসকদলের মতে এটা কেন্দ্রীয় বঞ্চনা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রের শাসক দলের বক্তব্য রেগার প্রকল্প রূপায়ণে  ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং  বহু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা অনুসৃত হয়নি। ২০১১ সাল থেকে কোন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সিএজি-র অডিট হয়নি। এই চাপান-উতোরের মাঝখানে ৯ মার্চ ২০২২ কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দেয় রেগা আইনের ২৭(২) ধারা জারি করা হয়েছে অর্থাৎ রেগার বরাদ্দ অর্থ রাজ্যকে দেওয়া স্থগিত থাকবে। একইসাথে রাজ্যে  দুর্নীতির ধরন, তার ব্যাপ্তি, নির্দেশিকা লঙ্ঘনের  ঘটনা, অবাস্তব ও অস্তিত্বহীন প্রকল্প ইত্যাদি যা কেন্দ্রীয় তদন্তে উঠে এসেছে তার ভিত্তিতে  ৮ জেলার তালিকা রাজ্য সরকারের কাছে  ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দেওয়া  হয়েছে। রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সেটাও মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী ১০ আগস্ট ২০২২ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দপ্তরে জানিয়েছেন। সেই অ্যাকশান টেকেন রিপোর্টে সব দুর্নীতি ও বেনিয়মের অভিযোগ স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন এ পর্যন্ত ৪০ জন সরকারি আধিকারিক ও কর্মীকে চিহ্নিত করা গেছে এবং তাদের মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। ১৯ জনকে কর্মচ্যুত করা হয়েছে এবং এক কোটি দশ লক্ষ সত্তর হাজার টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ পাঁচটি জেলা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উল্লেখ করা হলো। যে সংশোধনাত্মক ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাজ্য গ্রহণ করেছে তা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সংঘটিত অপরাধের তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ। কেন্দ্রীয় সরকার এধরনের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির ঘটনা লঘু করে দেখার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই তথ্য প্রমাণ করে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থাপিত বঞ্চনা বা প্রতিহিংসার তত্ত্ব ভিত্তিহীন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেস এই গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষদের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবেই বিচার করে। কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষাকারী বিজেপি সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পকে অপচয় বলেই মনে করে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার বছরের পর বছর রেগার বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে চলেছে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস নানাভাবে রেগার অর্থ থেকে খেতমজুর ও শ্রমজীবীদের বঞ্চিত করে দলের স্বার্থ সিদ্ধি করে চলেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের চৌর্যবৃত্তি এবং মনুবাদী  বিজেপি’র গরিব বিরোধী অবস্থানে খেতমজুর  ও গ্রামের শ্রমজীবীরা বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখে  দ্রুত নিষ্পত্তি করা এবং পুনরায় ১০০ দিনের কাজ চালু করা এই দায়িত্ব উভয় সরকারের। কেন্দ্রীয় সরকার অনির্দিষ্টকাল প্রকল্পের বরাদ্দ আটকে রাখতে পারে না।    
  
২০২৩ সালের ৬ জুন ১০০ দিনের কাজ সম্পর্কে দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলায়  কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারকে কাজ বন্ধ এবং মজুরি না দেওয়ার কারণ জানাতে নির্দেশ দেয়। এরই মধ্যে বিজেপি ও তৃণমূল উভয়ের কাছেই দাবি জানানো হয়েছে, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এমজিএনআরইজিএ-কে ইস্যু বানানো বন্ধ করা হোক। আদালত আরও বলেছে যে সরকারগুলিকে অবশ্যই  যারা প্রকৃতপক্ষে কাজ করেছেন এবং এখনও মজুরি  পাননি তাদের মজুরি মিটিয়ে দেওয়া  নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৃণমূল সরকারের  কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এই ছিল কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের পর্যবেক্ষণ। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা মজুরি পাননি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি এবং তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি এই অচল অবস্থাকে রাজনীতির মশলা হিসাবে ব্যবহার করছে।  যদিও  একথা বলা যায় যে আদালতে এই বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। উভয় সরকার আদালতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করলে  পুনরায় রেগার কাজ চালু করার ক্ষেত্রে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। বাংলার সাধারণ মানুষ চায় শুধু রেগার কাজ নয়, আবাস যোজনা, গ্রাম সড়ক যোজনা সহ সমস্তক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে এবং পুনরায় স্বচ্ছ ভাবে কাজ চালু করতে হবে। আমরা বিশ্বাস রাখি  দুর্নীতি নিরসন প্রসঙ্গেও উচ্চ আদালত সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করবে। 
রাজভবন ও উচ্চ আদালতের দূরত্ব বড় জোর ১৫০ মিটার। রাজভবনে এই সমস্যার কোনও সমাধান হবে না জেনেও মোচ্ছবটা চলেছে। এই অর্থহীন আন্দোলন যে নিছক প্রচারধর্মী  রাজনীতির জন্য তা বুঝতে কোনও পণ্ডিতের প্রয়োজন হয় না। তৃণমূলী নেতারা উচ্চ আদালতের অলিগলি ভালই চেনেন। প্রতিদিন রক্ষাকবচের জন্য এই নেতাদের বা এদের পক্ষের বাঘা আইনজীবীদের দেখা যায়। ১০০ দিনের কাজের অচলাবস্থা কাটাতে তৃণমূল বা রাজ্য সরকার আদালতে যাচ্ছে না কেন এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। কেন দ্বিধা, কীসের ভয়? আদালতে সওয়াল-জবাব চলাকালীন রাজ্যে কত ভুয়ো জবকার্ড আছে, কত ফেক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, ২০ লক্ষ জব ওয়ার্কারের মজুরি দেওয়া হয়নি বলা হচ্ছে তার মধ্যে কতজনের নাম ইতিমধ্যেই বাতিল হয়েছে, এযাবৎ ভুয়ো জব কার্ডে যে পরিমাণ অর্থ সাইফন হয়েছে সেটা কীভাবে উদ্ধার হবে, কী কারণে ১.৩ কোটি জব ওয়ার্কারের সংখ্যা কমেছে, কাজের সামাজিক নিরীক্ষা হয় না কেন ইত্যাদি বহু অস্বস্তিকর প্রশ্ন সামনে আসবে। রাজ্যে দুর্নীতি ও বেনিয়মের চালচিত্র প্রকাশ্যে আসবে। এই আশঙ্কা থেকেই  রাজ্য সরকার আদালতে না গিয়ে রাস্তার রাজনীতিকেই অবলম্বন করে অগ্রসর হতে চাইছে। 
রেগায় যারা সরাসরি উপকৃত বা যাদের জন্য এই আইন তৈরি হয়েছে তারা হলো গায়ের খেতমজুর এবং শ্রমজীবী। যন্ত্রপ্রযুক্তির আমদানির ফলে খেতে খামারে আগের মতো কাজ পাওয়া যায় না। গ্রামে বিকল্প কাজের সুযোগ না থাকায়  এদের ১০০ দিনের কাজের ওপরে নির্ভর করতে হয়। এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে হবে কেন্দ্রের সরকারকে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে  প্রকল্প রূপায়ণের প্রধান দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। খেতমজুর ও গায়ের শ্রমজীবীদের বন্ধ হয়ে থাকা রেগার কাজ চালু করার লড়াই এই দুই সরকারের বিরুদ্ধে। গত দু’-তিন বছরের অভিজ্ঞতায় তাঁরা এটা বুঝেছেন প্রকৃত প্রাপকদের বঞ্চিত করে রেগার অর্থ লুট করেছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং তাদের পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলি। রাজভবনের সামনে যে  আন্দোলন নামক আস্ফালন হল এবং অবশেষে মহামান্য রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যারপরনাই আনন্দিত হয়ে সোল্লাসে ফিরে গেলেন সেখানে গ্রামের গরিবের অংশগ্রহণ ছিল না। মিডিয়ায় ছবি তোলার জন্য দু’-চারজন জব ওয়ার্কারকে নানান প্রলোভনে শামিল  করা হয়েছিল। এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগ ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ অর্থ লুটপাট করেছেন। রেগার কাজ বন্ধ তাই এদের পকেটে আমদানি কমেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মাথাব্যথা এদের জন্য।  এদের পুনরায় করে কম্মে খাওয়ার ব্যবস্থা করতেই এই আন্দোলন। তারাও তিলকে তাল বানানোর আবহে নিজেদের রেগার অন্যতম বেনিফিসিয়ারি বলে ভাবতে শুরু করেছেন।

Comments :0

Login to leave a comment