কয়েকদিন আগে সংসদে ভাষণ দেবার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অন্তিম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ আর কিছুদিনের মধ্যেই কাশ্মীরে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। প্রধানমন্ত্রীর এহেন ঘোষনায় ভক্তরা যে পুলকিত হতে পারেন কিন্তু বাস্তবের মাটিতে পা রেখে যারা চলেন তারা জানেন প্রধানমন্ত্রী সত্য বলেননি। সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করতে সচেতনভাবেই ভুলভাল বলেছেন। ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ওয়ালার পক্ষে এছাড়া অবশ্য অন্য কিছু বলার উপায় ছিল না। সত্য স্বীকার করার মতো সাহস বা সদিচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর নেই, কোনোকালে ছিলও না। ঔদ্ধত্য আর অহংবোধের মিনারে যার অধিষ্ঠান নিজমুখে নিজের ব্যর্থতার কথা বলেন কি করে। বস্তুত কাশ্মীর নিয়ে মোদী-শাহরা যতই বড়াই করুন না কেন, কাশ্মীরকে ঘিরে সারাদেশে যতই ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা করুন না কেন, যত দিন যাচ্ছে ততই কাশ্মীরের পরিস্থিতি তাদের দুঃশ্চিন্তার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিস্ত মানসিকতার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কড়া চাবুকের ঘায়ে সব সোজা করে দেবেন বলে বড়াই করেছিলেন, লক্ষ লক্ষ সেনা আর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে গোটা কাশ্মীরকে মুড়ে দিয়ে সব ঠান্ডা করে দেবেন বলে উচ্চাশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আজ বোঝা যাচ্ছে বন্দুকের নল না বেয়নটের জোরে মানুষকে অবনত করা যায় না, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুস্থিতি আনা যায় না। তার জন্য সরকারকে নমনীয় ও সংবেদনশীল হতে হয়। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। তাদের সুখ দুঃখের সাথি হতে হয়। তেমন কোন পদক্ষেপ পরিহার করতে হয় যা মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে দুর্বিষহ করে, তাদের অধিকার কেড়ে নেয়। তাদের সন্দেহের চোখে দেখে অবিশ্বাস করে। এইভাবে সরকার ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে, মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে আর যাই হোক শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতি আনা যায় না। বহিরঙ্গে আপাত শান্তি দেখা গেলেও ভেতরে ভেতরে, ভয়ানক অসন্তোষ জমতে থাকে। আর তাকেই ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদীরা কাশ্মীরে এখন তেমনটাই ঘটছে। সন্ত্রাসবাদীর নতুন এলাকায়, নতুন আঙ্গিকে, নতুনভাবে সন্ত্রাসমূলক কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর তাদের মোকাবিলা করতে সরকারের নাজেহাল অবস্থা। মাঝখান থেকে বেঘোরে প্রাণ যাচ্ছে সেনা জওয়ানদের। মরছে নিরীহ মানুষ। সীমাহীন হয়রানি, নজরদারি আর অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতা দখল করে সদম্ভে সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫-ক ধারা বাতিল করে উক্ত কাশ্মীরের মানুষের বিশেষ অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের সরাসরি কেন্দ্রীয় সেনা শাসনের থাবার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন মোদী-শাহরা। বেনজির সেনা অভিযান চালিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয় জঙ্গি দমনে সারকারের সাফল্য। আপাত দৃষ্টিতে সাময়িকভাবে সন্ত্রাসবাদী হামলা কিছুটা কমলেও অথবা কিছুদিন কিছুটা থমকে থাকলেও নতুনভাবে তা বাড়তে শুরু করেছে। উপত্যকায় যেখানে এতকাল সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব বেশি ছিল এখন বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে সেটা স্থানান্তর হয়েছে জম্মু অঞ্চলে। জম্মু ক্রমাগত বাড়ছে সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব ও কার্যকলাপ। গত তিন বছরে জম্মুতে শতাধিক জঙ্গি হামলায় ৪৩ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ও পরে হামলা আরও বেড়েছে। মোদী যেদিন শপথ নেন সেদিনই সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত হয় ৯ জন তীর্থযাত্রী। এই সময়কালে পর পর ঘটে চলেছে হামলার ঘটনা। গত চারদিনে প্রতিদিনই হামলা হয়েছে। জঙ্গিদের নতুন নতুন কৌশলের কাছে পেরে উঠছে না সেনারাও। এই অবস্থায় কেবলমাত্র প্রশাসনিকভাবে সেনা নির্ভর দমনমূলক কৌশলে সাফল্য আসবে। অস্ত্র দিয়ে শান্তি আসে না। মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র রচনা করে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। তবেই তো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। ফ্যাসিস্তসুলভ হিন্দুত্ববাদীরা অবশ্য বাহুবল আর অস্ত্রেই বেশি বিশ্বাসী।
Editorial
দম্ভ দিয়ে সন্ত্রাসবাদকে হারানো যায় না
×
Comments :0