TMC threatened teachers

ধর্মঘটে অংশ নেওয়ায় চরম হেনস্থা শিক্ষকদের

রাজ্য জেলা

da government employees teachers tmc government bengali news নারায়ণগড় থানার সামনে বিক্ষোভে সামিল শিক্ষকরা। ছবি: চিন্ময় কর।

ধর্মঘট সফল হওয়ায় প্রতিহিংসার পথে নেমেছে তৃণমূল। বকেয়া ডিএ’র দাবিতে শুক্রবার স্কুলে না এসে ধর্মঘট করায় রাজ্যের বহু শিক্ষক, শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীদের শনিবার স্কুলে ঢুকতে দেননি তৃণমূলের স্থানীয়র নেতারা। মারধর করা, স্টাফ রুমে ঢুকে শিক্ষিকাদের নির্যাতন করা হয়েছে। বিবস্ত্র করার হুমকি দেওয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখার মতো অত্যাচারও করা হয় শিক্ষকদের। তারপরেও বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা তৃণমূলীদের প্রতিরোধ করেই স্কুলে ঢুকে ক্লাস নিয়েছেন। এই অত্যাচারের পরেও বকেয়া ডিএ’র দাবিতে যদি ফের ধর্মঘট ডাকা হয়, তাহলে সেই ধর্মঘটে শামিল হবেন বলে এদিন জানিয়েছেন তৃণমূলীদের হেনস্তার শিকার হওয়া শিক্ষক, শিক্ষিকারা।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নারায়নগড় ব্লকের  নারমা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মদনমোহন চক চৌধুরী হাইস্কুলে এদিন ১৯জন শিক্ষক শিক্ষিকাকে সারা দিন রোদের মধ্যে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রেখে চললো হেনস্থা সহ অশালীন মন্তব্য। স্কুলে ঢুকতে গেলে আগে দুই মাসের বেতন তৃণমূলের পার্টি দপ্তরে জমা দিতে হবে, নইলে স্কুলে ঢোকা যাবে না। এমন হুমকি সহ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে স্কুলের গেটে চাবি তালা লাগিয়ে সারা দিন রোদের মধ্যে শিক্ষকদের হেনস্তা করলো তৃণমূলীরা। 

জনা ৫০ জন তৃণমূল কর্মী স্কুলের গেট বন্ধ রেখে শিক্ষক শিক্ষিকাদের হেনস্থা সহ দুই মাসের টাকা জরিমানার হুমকি দেয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিস কুমার মান্না, সহকারী শিক্ষক চন্দন কুমার মাইতি, তুষার মন্ডল প্রমুখ বলেন, তাঁরা বেলা ১০.২০টায় স্কুলে পৌঁছে দেখেন স্কুলের দুটি গেটে তালা চাবি। সাড়ে দশটার সময় বাকি শিক্ষকরাও পৌঁছে যায়। তখন তৃণমূলের এই নেতা কর্মীরা তাদের ঘিরে ধরে হেনস্তা সহ অশালীন ভাষায় আক্রমণ করে। 

শিক্ষকরা নারায়ণগড় থানায় ফোন করলেও পুলিশ প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ডিআই’কে জানালেও এড়িয়ে যান বলে অভিযোগ।  বেলা সাড়ে চারটা পর্যন্ত শিক্ষকরা স্কুল গেটে রোদের মধ্যে থাকেন। তারপর এমন ঘটনার প্রতিকার চেয়ে এবং জরিমানার নামে তোলা আদায়ের  অযৌক্তিক দাবীর বিরুদ্ধে নারায়নগড় থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে উপস্থিত হোন। অনেক সময় ধরে শিক্ষকদের বসিয়ে রাখা হয় থানায়। থানার সামনে বিক্ষোভ অবস্থান শুরু করেন শিক্ষকরা। সামিল হন আরো বিভিন্ন স্কুলের অনেক শিক্ষক। 

শেষ পর্যন্ত থানায় অভিযোগপত্র দায়ের হয়। পুলিশ প্রশাসন দায়িত্ব নিয়ে বলেন তারা এর জন্য মীমাংসার সমাধান করবেন। শিক্ষকরা পরিষ্কার বলে দেন, তাঁরা কোনো পার্টির দলীয় দপ্তরে যাবেন না এবং কোনো জরিমানাও দেবে না। সোমবার যথারীতি স্কুলে আসবেন, বাধা পেলে থানায় এসে অবস্থান বিক্ষোভ করবেন। ডিআই দপ্তরেও অভিযোগ পত্র পাঠান শিক্ষকরা। অপরদিকে কেশপুরেও ধর্মঘটে সামিল হওয়ার জন্য শিক্ষকদের স্কুল থেকে বার করে  তালা চাবি লাগিয়ে দেয় তৃণমূল। 

কেশপুর ব্লকের আনন্দপুর চক্রের ঝাটিয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা শনিবার স্কুলে এলে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব ও বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির সভাপতি শিক্ষকদের বিদ্যালয় থেকে বার করে দেয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শিল্পা বোস বলেন, আমরা ডিএ আন্দোলনে শামিল হয়ে গতকাল স্কুলে অনুপস্থিত ছিলাম স্থানীয় নেতৃত্ব ও পরিচালন কমিটির সভাপতি আমাদেরকে বিদ্যালয়ে থেকে বের করে দেন। সেই সঙ্গে বলেন আপনারা চলে যান আমরা নিজেরা স্কুল চালিয়ে নেব।

এদিন তৃণমূলের কোপে পড়লেন রামনগর ১ ব্লকের খাদালগোবরা জুনিয়র বেসিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ধর্মঘট করায় এই স্কুলের শিক্ষকদের প্যান্ট খুলে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখার নিদান দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের স্কুলের বাইরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় এলাকার তৃণমূলীরা। শিক্ষকদের দাবি, ধর্মঘট সফল হওয়া প্রতিহিংসার পথে নেমে বহিরাগতদের লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। তবে ১১টা ৪০ মিনিটের পর অভিভাবকরা গিয়ে তৃণমূলের বহিরাগতদের স্কুল খুলতে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদ করায় তাঁরা পিছু হটে। 


জানা গিয়েছে, এই স্কুলের মোট ৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। তার মধ্যে ৫ জনই ডিএ’র দাবিতে ধর্মঘটে শামিল হয়ে স্কুল আসেননি শুক্রবার। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যাওয়ায় ওই একজনই ক্লাস নিয়েছেন। এরপর শনিবার সকালে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা এসে পৌঁছালে তাঁদের স্কুল খুলতে বাধা দেওয়া হয়। বহিরাগত তৃণমূলীদের সঙ্গে বচসা হয় ধর্মঘটী শিক্ষকদের সঙ্গে। তাতে দীর্ঘক্ষণ ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলের বাইরে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। 

স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফারুক আলি খান জানিয়েছেন, ”আমরা ধর্মঘটে শামিল হওয়ার জন্যে স্কুলে আসবো না বলে আগেই সার্কেল ইন্সপেক্টরকে ই-মেলের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছি। শুক্রবার একজন শিক্ষক এসে ক্লাস করেছেন। ৫ জন ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে এসেছিল। তাদের পুরো ক্লাস নেওয়া হয়েছে। কিছু বহিরাগত যাঁরা অভিভাবক নন, তাঁরা এদিন স্কুলে এসে মারমুখী আচরণ করেন। স্কুল খুলতে বাধা দেন।”

তৃণমূলের হুমকি উপেক্ষা করে প্রতিরোধ গড়ে তুলে হাওড়ার বেশ কয়েকটি স্কুলে ঢুকলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ডোমজুড়ে নোনাকুণ্ডু মহাদেব বিদ্যামন্দিরের ১৬ জন শিক্ষক। শুক্রবার ধর্মঘটে শামিল হয়েছিলেন সকলেই। বন্ধ ছিল স্কুল। শনিবার প্রতিদিনের মতোই স্কুলে এলে স্কুলের গেটে তালা দেখতে পান শিক্ষকরা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে স্থানীয় শাসক দলের কর্মীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে কাল স্কুলে না আসার জবাবদিহি চান। স্কুলে চলে আসেন প্রধান শিক্ষক স্বপন মাখাল। তিনি তাঁর সহযোগী শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে জোর করে স্কুলে ভিতরে ঢুকে স্কুল চালু করেন। 

আমতার মাতো হাই স্কুল ও পাঁচলা আজিম মোয়াজ্জেম হাই স্কুল। এদিন মাতো হাই স্কুলে এসে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকরা দেখেন গেটে তালা দেওয়া। তার পরে তালা ভেঙে স্কুলে ঢুকে যান। পাঁচলা আজিম মোয়াজ্জেম হাই স্কুলে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করা ৩৪ জন শিক্ষক স্কুলে এলে তাঁদের বাধা দেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। তৃণমূলের হুমকি উপেক্ষা করে শিক্ষকরা স্কুলে ঢুকে যান। আমতার বাগুয়া হাই স্কুল, উদয়নারায়ণপুরের সারদা চরণ ইনস্টিটিউটশন, বড়দা হাই স্কুল, গড় ভবানীপুর আর কে ইনস্টিটিউট, গড় ভবানীপুর ঊষারানী করাতী গার্লস হাই স্কুলে শিক্ষকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

 
ধর্মঘটে অংশ নেওয়ায় এদিন সকাল ১০টা থেকে রাজবলহাট হাই স্কুলে তৃণমূলের বাইক বাহিনী স্টাফরুমে ঢুকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর তাণ্ডব চালায়। সিসি টিভির ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে একাধিক শিক্ষকের উপরে স্টাফরুমের ভিতরে হামলা চালায়। বেশ কয়েকজন শিক্ষককে রাস্তাতেও ব্যাপক মারধর করে রক্তাক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়ে কেশিয়াড়ির কুলবনি স্কুলের ১৮জন শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। শনিবার সকালে স্কুল খুলতেই সেই শিক্ষকদের স্কুলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। ফলে তাঁদের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় স্কুলের মাঠে। মাত্র ৬ জন শিক্ষক ঢুকতে পেরেছিলেন ক্লাসে। ডিএ ধর্মঘট সমর্থন করে যে ১৮ জন গরহাজির ছিলেন তাঁদের এভাবে ‘শাস্তি’ পেতে হলো।

প্রায় একই পরিস্থিতি কাঁথি, বর্ধমানেও। বর্ধমানের দেওয়ানদিঘির নরেন্দ্রনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই পরিস্থিতি। সকালে পড়ুয়ারা স্কুলে গিয়ে দেখেন, তালা বন্ধ। শিক্ষকরা ধর্মঘটে শামিল হবেন বলে ছুটির আবেদন দিয়েছিলেন। এরপর শনিবার স্কুলে গেলে তাঁদের ঢুকতে বাধা দিয়ে তালা আটকে রাখেন অভিভাবকরা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর গাছতলায় দাঁড়িয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের একপ্রস্ত পড়িয়েছেন শিক্ষক সুব্রত সেন। 

কোচবিহারের মাথাভাঙা পচাগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের কুঞ্জবিহারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কুঞ্জবিহারী জুনিয়র হাই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আটকিয়ে রাখে শাসকদলের লোকজন। কেন শুক্রবার তাঁরা স্কুলে আসেননি, তার জন্য কৈফিয়ত তলব করা হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে শিক্ষক, শিক্ষিকারা স্কুলে ঢোকেন। বর্ধমানের পূর্বস্থলী ১ নম্বর ব্লকের হাট শিমলা জুনিয়র হাই স্কুলের শিক্ষকরা এদিন স্কুলে ঢুকতে গিয়ে তৃণমূলীদের বাধার মুখে পড়েন। বর্ধমানে কাঁকসার মলানদিঘি উচ্চ বিদ্যালয়ে এদিন একই দৃশ্য দেখা যায়। কাঁকসায় শুক্রবার একাধিক সরকারি স্কুল খোলা থাকলেও শিক্ষক শিক্ষিকিরা হয় আসেননি, নতুবা এলেও ক্লাস করেননি। কোনও কোনও স্কুলে টিফিনের পর ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। 

এদিন মলানদিঘি দুর্গাদাস বিদ্যামন্দিরে গেট বন্ধ করে শিক্ষকদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তৃণমূলীদের সঙ্গে শিক্ষকদের বচসাও হয়। কাঁকসা থানার পুলিশ আসে। বাঁকুড়ার বেলডাঙা প্রাথমিক বিদ্যরায় শুক্রবার সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এই স্কুলের পাঁচ শিক্ষক-শিক্ষিকা ধর্মঘটে শামিল হওয়ায় কোনও ক্লাস হয়নি। শনিবার তৃণমূলের লোকজন স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পূর্ব মেদিনীপুরে দিঘায় খাদাল গোবরা জুনিয়র বেসিক স্কুলে শনিবার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চরম হেনস্তার শিকার হতে হয়। ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার জন্য ঘণ্টাখানেক তাঁদের স্কুলের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। অকথ্য গালিগালাজ করা হয়। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদেরও একইভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এখানেই শেষ নয়, তাঁদের মারধর করারও হুমকি দেন তৃণমূল নেতারা। তৃণমূলের অঞ্চল সদস্য সুশীল প্রধান এবং গ্রাম সদস্য বিশ্বজিত জানা শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ।

পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে মদন মোহন চক চৌধুরি ইনস্টিটিউশনে শনিবার ১০টা থেকে ২টো পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলের বাইরে সময় কাটাতে বাধ্য হলেন। ধর্মঘটে অংশ নেন বলে এদিন স্থানীয় তৃণমূলের লোকজন এদিন স্কুলে তালা লাগিয়ে দেন। পরে উচ্চ মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড দেওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষক আশিস কুমার মান্না এবং করণিকদের স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রবেশের অনুমতি ছিল না।
 

Comments :0

Login to leave a comment