Train accident

দুর্ঘটনার ৪৮ঘণ্টা পরেও মর্মান্তিক দৃশ্য

জাতীয়

রামশংকর চক্রবর্তী: বালেশ্বর 
 

দুর্ঘটনার পর দু’দিন কেটে গিয়েছে। মিলছে না পরিজনের খোঁজ। একবার কটক, একবার ভুবনেশ্বর, ঘুরে বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে পৌঁছেছে দুই পরিবার। হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে পরিজনকে। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে সুমিত ঢলের ছবি নিয়ে খুঁজছে তাঁর দাদা গৌরাঙ্গ ঢল। বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর এলাকায়। 
গৌরাঙ্গ জানালেন, তাঁর ২২বছরের ভাই কেরালা যাচ্ছিল রড বাইন্ডিং-এর কাজে। ‘‘আমি খড়্গপুরে তুলতে এসেছিলাম। রিজার্ভেশন না পাওয়ায় জেনারেল কামরায় উঠেছিল আমার ভাই। আমি খড়্গপুর এলাকাতেই ছিলাম। আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি, সেদিন ভাইকে গাড়িতে তুলে দিয়ে খড়্গপুরের গোলবাজারে আড্ডা মারছিলাম। তারপর জানতে পারি ট্রেন দুর্ঘটনার খবর। সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে ফোন করি। কিন্তু ফোন লাগছিল না। আমরা কটকের হাসপাতাল, ভুবনেশ্বর এইমস-এ খুঁজেছি। যে মৃতদেহগুলি আছে সেগুলোও দেখেছি, কিন্তু ভাইকে পাইনি। এখনই বালেশ্বর হাসপাতালে এসেছি। এখানেও ভাইকে পেলাম না। মর্গেও ভাইয়ের দেহ নেই। কী যে করব, তা কোনভাবে বুঝতে পারছি না।’’
গৌরাঙ্গের মতোই নিজের দিদি-জামাইবাবুকে খুঁজছেন বিহারের মতিহারি জেলার সাবন্ত, সুরজ, দুই ভাই। তাঁর জামাইবাবু কেরালার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন, দিদিও মাঝেমধ্যে সঙ্গে যান। এবার দিদি আর জামাইবাবু একসঙ্গেই যাচ্ছিলেন। ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সুরজ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে প্রথমে বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে আসে। এখানে কোনও খোঁজ না পেয়ে হাসপাতালে থাকা ওডিশা প্রশাসনের সহায়তা কেন্দ্র থেকে তাঁদের ভুবনেশ্বর এইমস-এর কথা বলা হয়। সেখানে সুরজের দাদা সাবন্ত যায়। কিন্তু সেখানেও দিদি ও জামাইবাবুর কোনও খোঁজ পায়নি। ‘‘কালভি হামলোগ বাহানগা কি উও স্কুলমে গিয়া থা। উহাপে বহুত বডি থা। উস মে হামারা দিদি অর উসকা পতি নেহি থা। হামলোগ ফির বালেশ্বর কি ইস হাসপাতাল মে আ কর বহুৎ ঢুনডা। লেকিন আভিভি নেহি মিল রাহা হ্যাঁয়।’’ সুরজের দিদির নাম লক্ষ্মী কুমারী আর জামাইবাবুর নাম রাজীব। বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেল এই দুই নামের কেউ এখানে চিকিৎসাধীন নেই। রেলওয়ে প্রশাসন ১৬৮টি মৃতদেহের ছবি দিয়ে যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা দেখানো হলো সুরজদের। কিন্তু এখানেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর দিদি ও জামাইবাবুকে। 
প্রসঙ্গত, মৃতদেহগুলির যে ছবি তালিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বহু মৃতদেহই চিহ্নিতকরণ করার অবস্থায় নেই। এমনভাবে বিকৃত হয়েছে, যে দেখে সহজে অনুমান করা যাচ্ছে না কোনটি কার মৃতদেহ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, দুর্ঘটনাগ্রস্ত কামরাগুলি থেকে যে সমস্ত মৃতদেহগুলি উদ্ধার করা হয়েছে তাদের ওপর যে সমস্ত কাপড় বা চাদর আপৎকালীনভাবে ঢাকা দেওয়া হয়েছিল এবং মৃতদেহর তালিকাতে যাদের গায়ে যে সমস্ত চাদর বা কাপড় ঢাকা দেওয়া রয়েছে, সেগুলি যে তাদেরই তাও কিন্তু বলা মুশকিল। কারণ দুর্ঘটনার সময় যেভাবে করমণ্ডল ও যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের কামরাগুলি দুমড়ে গিয়েছে, তাতে ওই সমস্ত সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কামরায় থাকা মানুষজন একেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলেন। উদ্ধারকারীরা মৃতদেহগুলি যখন উদ্ধার করে রেলওয়ে ট্রাকের উপর রেখে তাদের উপর কাপড় বা চাদর ঢাকা দিয়েছিল, সেগুলি যে কার কোনটা তা তখন কেউই ভাবেনি। কারণ সেটাই স্বাভাবিক। কিছু মৃতদেহ এমনভাবে বিকৃত হয়ে রয়েছে, যাদের মুখ বা শরীর দেখে কোনভাবেই চিহ্নিতকরণ করতে পারছে না কেউই।
এখনও বালেশ্বর জেলা হাসপাতালে যে সমস্ত আহতরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে থাকা বহুজনেরই খোঁজ পাচ্ছেন না তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেল। বিশেষ করে দুটি ট্রেনের অসংরক্ষিত কামরাগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এই কামরাগুলির যাত্রীদের সংরক্ষিত টিকিট না থাকায় কোনও ফোন নাম্বার বা নাম বা ঠিকানা কোনটাই রেলের কাছে লিপিবদ্ধ নেই। ফলে এই যাত্রীদের যারা মৃত, তাঁদের চিহ্নিত করার একমাত্র ভরসা তাঁদের পরিবারই। আবার এই কামরাগুলির যে সমস্ত যাত্রীরা এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ, তাঁদের খোঁজ রেলওয়ে বা ওডিশা রাজ্য প্রশাসন বা পরিবার কারোরই পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সেই সমস্ত নিখোঁজ পরিবার এবং সাধারণ মানুষ তাদের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, তাহলে কি উদ্ধার কাজ ঠিকমতো করা হয়নি ? বা উদ্ধারকাজ হয়ে থাকলে এই সমস্ত নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায় ? আপাতত এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বালেশ্বর এলাকাজুড়ে। 
বাহানাগার এক বাসিন্দা সুমিত জেনার একটি পান, চা দোকান রয়েছে বালেশ্বর শহরে হাসপাতালের কিছুটা দূরে। পান দোকানদার ওই ব্যক্তি জানালেন সেদিনের ঘটনার বীভৎসতার কিছু কথা। তবে তাঁর একটি কথাতে গভীর আশঙ্কা এবং রহস্যের সন্ধান মিলেছে। ‘‘যখন দুর্ঘটনা ঘটল সেদিন আমি খবর পেয়েই বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছিলাম। ৪৫ মিনিট পর বাড়ি ফিরে যখন দেখি বীভৎস অবস্থা। তখনো উদ্ধারকারী বা পুলিশ, সেভাবে কেউ আসেনি। স্থানীয়রাই হাত লাগিয়েছিলেন উদ্ধারকাজে। আমিও বেশ কয়েকজনকে বের করেছিলাম। পরেরদিন সারাটা দিন আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম। আমার যা মনে হয়েছে কয়েকশো মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই ঘটনায়। সবাইকে বের করতে পারা গেছে কিনা তা সন্দেহ রয়েছে।’’ 
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দা এই ব্যক্তির কথার সঙ্গে মিলছে বিহারের বাসিন্দা সুরজ এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের গৌরাঙ্গের কথা। বালেশ্বর জেলা হাসপাতাল, শহরের আইটিআই মোড়, পুলিশ লাইন মোড়, বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় এখন একটাই চর্চার বিষয়। তা হলো বহু মানুষের নিখোঁজ থাকাটা। যেভাবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজনদের ভিড় বালেশ্বর জুড়ে বাড়ছে তা রীতিমতো আশঙ্কারও বটে। তবে কি ওই নিখোঁজরা মৃত? যদি মৃতই হন, তাহলে তাঁদের দেহ কোথায়? কেনই বা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা আহত ব্যক্তিরা তাঁদের সঙ্গী, সাথিরদের খোঁজ পাচ্ছেন না বলছেন? 
বালেশ্বর জুড়ে শুধুই হাহাকার, শূন্যতার ভিড়। কিছু দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁদের পরিজনদের। কিছু দৃষ্টি মৃত ব্যক্তিদের ছবির দিকে চোখ বোলাচ্ছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না তাদের পরিবারের লোকদের। এক অসহনীয় ঘটনা। বালেশ্বর জেলা হাসপাতালের গেট দিয়ে যখন ঢুকছি তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন এলাকার লক্ষীরাম মাহাতো একটি নাম দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘এ কোথায় আছে?’’ নামটি একটি ছেলের। ৩২বছরের রাজকুমার মাহাতো বাঙ্গালোরে ঠিকা মজুরের কাজ করতে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিলেন সেকথা ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে। 
তারপর দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাঁর বন্ধু পেশায় টোটোচালক লক্ষ্মীরাম ছুটে এসেছিলেন ওডিশা। প্রথমে দুর্ঘটনাস্থল, তারপর এই বালেশ্বর হাসপাতাল। কিন্তু কিছুতেই মিলছে না বন্ধুর খোঁজ। তবে মৃতদের ছবির তালিকায় থাকা একজনের গায়ে লাল রঙের চাদরটি বন্ধুর বলে অনুমান তাঁর। তবে ওই মৃতদেহটি তাঁর বন্ধুর নয় তেমনটাই তাঁর কথা। ‘‘বাঙ্গালোরে ঠিকা মজুরের কাজ করে আমার বন্ধু। ও নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এখানে কাজ নেই, কী আর করবে, তাই পাঁচ-সাত বছর ধরে বাঙ্গালোরে কাজ করে। বছরখানেক পর বাড়ি ফিরছিল। কিন্তু কী করতে কি হয়ে গেল!’’
এমন নানান ঘটনার সাক্ষী এখন বালেশ্বর। কীভাবে বা কবে পরিজনদের খোঁজ মিলবে, তার নিশ্চিত উত্তর জানা নেই এই সমস্ত মানুষের কাছে।

Comments :0

Login to leave a comment