Voter List

দেদার মৃত, এলাকাত্যাগীরা বহাল তবিয়তে ভোটার তালিকায়

রাজ্য

 ৭৪ জনকে চিহ্নিত করেছিলেন বুথ লেবেল এজেন্ট (বিএলএ)। প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গেছেন তিনি। তাঁদের নামে ভোট পড়েছে সাম্প্রতিক প্রতিটি নির্বাচনে। কিন্তু তাঁরা কেউ যেখানে ভোট দিয়েছেন, তার আশপাশে আর থাকেন না। বুথ লেবেল এজেন্ট জোগাড় করতে পেরেছিলেন সেই ৭৪ জনের অনেকের বর্তমান ঠিকানা। তিনি গেছিলেন এমন ৩১টি ঠিকানায়। সেখানে দেখা পেয়েছেন সেই ভোটদাতাদের। তাঁরা আর আগের বাসস্থানের জায়গার বুথে ভোট দিতে যান না। কিন্তু তাঁদের নামে ভোট পড়ে।
সেই এলাকা ছেড়ে বেশ কয়েক বছর আগে চলে যাওয়ার ব্যক্তিদের নাম, ৩১ জনের বর্তমান ঠিকানা সহ জেলা শাসককে জমা দিয়েছেন সেই বুথ লেবেল এজেন্ট মিলন শিকদার। কিন্তু সেই ৭৪ জনের নাম যথারীতি ভোটার তালিকায় রয়ে গেছে। নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত ৮৮/২৮২ পার্টের এই ঘটনা প্রমাণ করছে রাজ্যের ভোটার তালিকায় কী হয়ে আছে। বিএলএ মিলন শিকদার জেলা শাসক তথা জেলার নির্বাচনী আধিকারিককে চিঠিতে লিখেছেন,‘‘...এই রকম ভোট দেওয়া একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, যা জনমতকে প্রভাবিত করে।’’
এমন লক্ষ লক্ষ বেআইনি নাম, মৃতদের নাম রাজ্যের ভোটার তালিকায় রেখে দিয়েছে তৃণমূল। বিজেপি এই নিয়ে কোনও প্রতিবাদ করে না। সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বারবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে এই বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু নামগুলি বাতিল হয়নি। এখন মমতা ব্যানার্জি ভোটার তালিকায় ‘ভূত’ নিয়ে সরব হয়েছেন। তবে তাঁর কৌশল পুরোপুরি আলাদা। তিনি দাবি করেছেন যে, ভোটার তালিকায় ভিন রাজ্যের মানুষের নাম ঢুকিয়েছে বিজেপি। আর বিজেপি এই নিয়ে শোরগোল তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় যে প্রচুর মৃত এবং অন্যত্র চলে যাওয়া মানুষের নাম রয়ে গেছে, তা আড়াল করতে চাইছে দুই দলই। আসলে ভোটার তালিকা নিয়েও দ্বন্দ্ব শুধু তৃণমূল আর বিজেপি’র মধ্যে—  তা দেখিয়ে মানুষকে দুটি দলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে তারা। 
কিন্তু বাস্তব অন্য। মৃত, অন্যত্র চলে যাওয়ার মানুষের নাম বাদ দেওয়ার দাবি মূলত বামপন্থীদের। তাঁদের দাবি কতটা ন্যায্য, তার অনেক প্রমাণ রাজ্যের বুথগুলিতে। যেমন, হুগলীর চণ্ডীতলা। পার্টি নং-২৮২। সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে ১৫টি নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছিল। কারণ, কৃষ্ণা ঘোষ, তাপসী চ্যাটার্জি, লিলি চাল, গোপাল পাল, রাধারানি ভট্টাচার্য, তুলসি রাজভরের মতো ওই ১৫জনই মৃত। এই ১৫জনের মধ্যে ১৩জনের মৃত্যুর তথ্য সিপিআই(এম) সেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে সংগ্রহ করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বাদ দিয়েছে ৫জনের নাম। বাকি ১০জনের নাম রেখে দেওয়া হয়েছে। 
তৃণমূল না চাইলে মৃতদের নাম থাকতে পারে না ভোটার তালিকায়। বিজেপি কোনও আপত্তি জানায়নি। মৃতদের নাম ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতি করে তৃণমূল, গ্রামবাসীদের অভিযোগ তেমনই। শুধু গ্রামেই নয়, এই কারসাজি ছড়িয়ে আছে শহরেও। যেমন যাদবপুর বিধানসভা এলাকা। সেখানে ভোটার তালিকায় ১৬৫নং পার্টে আছে ৭০৮জনের নাম। তার মধ্যে ৪৮জন মৃত। সবারই মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। এছাড়া ৩২টি এমন ব্যক্তির নাম আছে, যাঁরা এলাকায় থাকেনই না। চলে গেছেন। তবু তাঁদের নাম ভোটার তালিকায়। নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ জানিয়ে কোনও লাভ হয়নি। ওই অংশেরই পাশে পার্ট নং ১৬৬। সেখানে ভোটার তালিকায় নাম আছে ৬৯৮জনের। তার মধ্যে ৪৭জন প্রয়াত হয়েছেন। নাম বাতিলের আবেদন সত্ত্বেও সেই নামগুলি ভোটার তালিকায় রেখে দেওয়া হয়েছে। যাদবপুরেরই ৩০নং পার্টে এমন ৩৮জনের নাম বাতিলের আবেদন জানানো হয়েছিল, যাঁরা মারা গেছেন। কিন্তু লক্ষ্মী সেন, বিশ্বনাথ বোস, সুনীল কুমার ভট্টাচার্য, দিলীপ ভৌমিক, ফাল্গুনি প্রসাদ মুখার্জির মতো ওই মৃতদের সবার নাম তালিকায় রয়েছে।
একই ছবি হলদিয়া বিধানসভার অনেকগুলি জায়গাতে আছে। এই কেন্দ্রে বিধায়ক বিজেপি’র। সাংসদও বিজেপি’র। কিন্তু মৃতদের নাম বাতিলে তৃণমূলের কোনও উদ্যোগ নেই। এই বিধানসভার ১৬১নং পার্টের বিএলএ জয়ন্ত কুমার মাইতি ৩২জন মৃতর নাম চিহ্নিত করে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ভোটার তালিকায় সমরেন্দ্র জানা, গৌরহরি প্রামাণিক, রুমা মাইতি, সূর্যকান্ত মাজি, বিজয় মিশ্র, রামকৃষ্ণ শিট, বিমান বিহারী সাহু, হরিপ্রিয়া গুড়িয়া, চন্দ্রকান্ত গুড়িয়া, আশালতা মোদকের মতো এই ৩২জনেরই নাম রয়েছে। অন্যত্র চলে গেছেন, এই অংশেরই এমন ৮জনের নাম বাতিলেরও আবেদন জানানো হয়েছিল। গ্রাহ্য হয়নি। সবার নাম রয়েছে তালিকায়। আশেপাশের ১৬০, ১৬৩-র বেশ কয়েকটি পার্টেরও অনেকগুলি নামের বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছিল সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে। 
ভোটার তালিকা নিয়ে বুথ এলাকাগুলিতে সমীক্ষা করছেন সিপিআই(এম) কর্মীরা। আরও অনেক নাম চিহ্নিত হচ্ছে, যেগুলি ভোটার তালিকায় থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশাসনের সহায়তায় তৃণমূল তা রেখে দিচ্ছে। হলদিয়ায় তৃণমূল থেকে বিজেপি’তে যাওয়া এক নেতার কথায়,‘‘মৃত, অন্যত্র চলে যাওয়া ভোটারের বদলে ফলস ভোট দেওয়া সহজ। বিরোধীদের বুথ এজেন্টকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা গেলে, নিঃশব্দে ওই নামের ভিত্তিতে ভোট দেওয়া হয়। কোনও গোলমালও হয় না। ইভিএম লুট, বুথ দখল করতে হয় না। এই পদ্ধতিতে ভোট তৃণমূল করে। তা আমরা জানি।’’ কিন্তু বিজেপি আপত্তি করছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সেই বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘মৃতদের তালিকা আমাদের কাছেও আছে অনেক জায়গায়। কিন্তু মৃতদের সব ভোট তৃণমূলই একা দিয়ে দিতে পারবে, এমনটা আমরা মনে করছি না।’’

Comments :0

Login to leave a comment