মোদী দেশে কি রকম অমৃতকাল টেনে নামিয়েছেন যেখানে কেন ৮০ কোটি মানুষের নিজের খাদ্য কেনার ক্ষমতাটুকু নেই? মোদীর নির্বাচনী প্রচারে ফের পাঁচ বছরের জন্য বিনামূল্যে খাদ্যশস্য ঘোষণা করায় এই প্রশ্ন উঠে এসেছে। মোদীর ঘোষিত অমৃতকালেই ধসেছে দেশের অর্থনীতি। ভারতকে বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি গড়ে তোলার যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে তা অস্তাচলে চলে গেছে বলা যায়। মোদীকে বিশ্বগুরু হিসাবে তুলে ধরার বিজেপি প্রচারও অনেকটা প্রহসন হয়ে গেছে। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারে মোদীর রাজনৈতিক অর্থনীতির পরস্পর বিরোধী যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। যদিও মোদীর ঢাউস নির্বাচনী প্রচারে যুক্তির প্রশ্ন চিরকাল উপেক্ষিত থেকে যায়। কোনও প্রশ্নের জবাব মেলে না। জবাব দেওয়ার দায়ও নেই। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট অর্থনীতির ধস প্রকট হওয়ায় প্রচার চলছে রঙচড়িয়ে।এমনকি দুদিন আগে যে জন কল্যান প্রকল্পে বিরোধীদের অর্থ বরাদ্দ ‘খয়রাতি’ দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করেছে বলে গাল পেরেছেন মোদী সেই ‘খররাতি’র পথে যেতে তিনি এখন দ্বিধা করছেন না।এতে মোদী শিবিরে অনেকটা মরিয়া ভাব লক্ষ্য করা গেছে।
দেশের মোদী জমানার অমৃতকালে গরিবের দু’বেলা ক্ষুধার অন্ন অধরা হয়েছে এটা বাস্তব চিত্র বলে উঠে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন মোদী সরকার প্রায় ১০বছর ক্ষমতা রয়েছে। যা খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের মতো মূল চাহিদাকে অনেকটা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময়। সেই সময়ে পেরিয়ে অমৃতকালের ঘোষণা হলেও মূল চাহিদা পুরো মেটেনি। আজও বিনামূল্যে গরিবের অন্নের সংস্থান করতে হচ্ছে। করোনা মহামারীর সময় প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনায় যে বিনামূল্য খাদ্য শস্য দেওয়া হয়েছে সেই প্রকল্প পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে এতে স্পষ্ট হচ্ছে,দেশে অনাহার বাড়ছে, বেকারি বাড়ছে, আয় কমে যাওয়ায় মানুষের সঞ্চয় কমছে, আয় কমে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় শিল্প পণ্যের বাজার কমছে, শিল্পে বিনিয়োগ কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। কমেছে রপ্তানি। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে অর্থনীতির এই বিধ্বস্ত ছবি স্পষ্ট হলেও, নির্বাচনী প্রচারে কিন্তু মোদী তার আমলে ভারতে ইতিমধ্যে বিশ্বের উন্নততর অর্থনীতি গড়ে তুলেছেন বলে দাবি করে চলেছেন।
ভারতের বিধ্বস্ত অর্থনীতি সংক্রান্ত যে যে জরুরি তথ্য আজ সামনে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা সুচক। ভারত গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ২০২৩ সালে ১২৫ দেশের মধ্যে ১১১ স্থনে নেমে এসেছে। গত বছরের তুলনায় চার ধাপ নিচে এসেছে ভারত। উন্নত অর্থনীতিতে উপরের দিকে ওঠার কথা, অবনতি ঘটাতেই ক্ষুধা সূচকে নিচে নামছে ভারত। মোদী বারে বারে দাবি করেছেন ২০২৮ সালের মধ্যে ভারতকে তিনি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে গড়ে তুলবেন। কিন্তু যে হারে ক্ষুধার সুচকে ভারত নিচের দিকে নেমেছে তাতে অর্থনীতিও যে নিচের দিকে নামায় মোদীর বৃহত্তম অর্থনীতি বরবাদ হয়ে গেছে বলা যায়।
এদিকে মোদী বারে বারে জনকল্যাণ প্রকল্পে বরাদ্দকে খয়রাতি বলে দাবি করে এসেছেন। সেখানে ইউপিএ সরকার গ্রামীণ কর্মসংস্থানে যে রেগা প্রকল্প চালু করেছে তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন কংগ্রেস গরিবি দূর করতে পারেনি তাই রেগা চালু করেছে। তিনি জানিয়েছিলেন তার সরকার যে অর্থনীতি গড়ে তুলছে তাতে রেগার প্রয়োজন হবে না। এই রেগা প্রকল্প তুলেই দেওয়া হবে। এতে তাই বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এবছর ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় রেগার কাজের চাহিদা এতোই বেড়েছে যে বরাদ্দের ৯৩ শতাংশ অর্থ ছয় মাসের মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। মোদীর দাবি মতো যে উন্নততর অর্থনীতি তিনি গড়েছে তাতে সামান্য মজুরির রেগার কাজ মানুষ আর করবে না। তার এই দাবি ধোপে টেকেনা তা দেশে রেগার বিপুল চাহিদা বাড়ায় প্রমাণ হয়ে গেছে।
মোদী বলেছিলেন দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন(জিডিপি) বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে নিয়ে যাওয়া হবে। গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতা হলো দুই অঙ্কে দূরের কথা তা এক অঙ্কে আবার নিচের দিকে চলে এসেছে। ১০ বছরে গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার হলো মাত্র ৫.৭ শতাংশ। অন্যদিকে বিপুল আর্থিক বৃদ্ধির ঘোষণা করে বছরে ২কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদী। দেশের আর্থিক বিকাশ থমকে যাওয়ায় বছরে ২কোটি চাকরিও হয়নি। এদিকে সরকারি তথ্যে জানানো হয়েছে পিরিওডিক লেবার সার্ভেতে দেখা গেছে ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে স্বনিযুক্তি প্রকল্পে কর্মসংস্থান মোট কর্মসংস্থানের ৫৮ শতাংশ দাড়িয়েছে। এদিকে দেশের স্বনিযুক্তি প্রকল্পের ৩৫ শতাংশ শ্রমিক বিনা মজুরিতে কাজ করেন। শিল্প কলে কারখানায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় স্বনিযুক্তি প্রকল্পে কর্মসংস্থান বেড়ে চলেছে। অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহোত্রা এপ্রসঙ্গে জানাচ্ছেন,সরকারি তথ্য অনুসারে ২০১৭-১৮ সালে স্বনিযুক্তি প্রকল্পে কর্মসংস্থান ছিল ৪কোটি যা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৯.৫কোটি। দ্বিগুণের উপর বেড়েছে সংনিযুক্তি প্রকল্পে কর্মসংস্থান। মেহোত্রা জানাচ্ছেন স্বনিযুক্তি প্রকল্পে সব থেকে নিম্ন মানের কর্মসংস্থান হয়। কোথাও কোনও চাকরি বা কর্মসংস্থান না মেলায় বাধ্য হয়েই স্বনিযুক্তি কোনও প্রকল্পে নেমে পড়েন অনেকে। মুলত পরিবারিক মুদিখানা, ছোট দোকান, চপ, পকোড়া , সবজি দোকানের কাজ কে স্বনিযুক্তি প্রকল্প ধরা হয়। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিনা মজুরিতে কাজ হয় বলেই বিবেচিত হয়। আইএলও এই স্বনিযুক্তি প্রকল্পকে বিনা মজুরির কাজ বলে গণ্য করে। আইএলও ৯২ সদস্য দেশ তা মেনে থাকে।
এদিকে দেশের বড় অংশের শ্রমিক স্বনিযুক্তি প্রকল্পে বিনা মজুরির কাজে যুক্ত হওয়ায় তা দেশের বেহাল অর্থনীতিকে চিহ্নিত করছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান,মোদী সরকার বছরে ২ কোটি চাকরি দূরে থাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির কাজ দিতে পারেনি। তাই তাদের পরিবারের বিনা মজুরির স্বনিযুক্তি প্রকল্পের কাজে যুক্ত হয়ে পড়তে হচ্ছে। এদিকে শ্রমিকের মজুরি সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, স্থায়ী ও অসংগঠিত শিল্পে শ্রমিকদের মজুরি ২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ সালে ২০ শতাংশ হারে কমেছে। মূল্যবৃদ্ধির হার ধরলে প্রকৃত মজুরি আরও বেশি কমেছে। অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন গত পাঁচ বছরে চাকরির বাজারে হার নিম্ন মানের কম বেতনের চাকরি বেড়েছে। ভালো মানের ও ভালো বেতনের চাকরি কমে গেছে। দেশের জনসংখ্যার ৬০-৭০ অংশ যারা বিভিন্ন কাজে যুক্ত রয়েছে তাদের বেতন গত পাঁচ বছর ধরে একই জায়গায় দাড়িয়ে আছে। তা বাড়েনি। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করলে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে।
এদিকে শ্রমিকদের বেতন কমে যাওয়া বিনা মজুরিতে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে চলায় বাজারে শিল্প পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। সরকারি সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে গ্রামে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বিপুল পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এতে হিন্দুস্থান লিভারের মতো সংস্থার ভোগ্য পণ্যের বিক্রি বিপুল হারে হ্রাস পেয়েছে। স্কুটার নির্মাণ সংস্থা বাজাজ জানাচ্ছে, তাদের গ্রামীণ বাজারে স্কুটার বিক্রি গত পাঁচ ছয় বছর আগে যা ছিল তার থেকে ৪০ শতাংশ হারে কমে গেছে। বাজাজের এই হারে স্কুটার বিক্রি কখনো কমেনি বলে জানা গেছে। ভোগ্য পণ্য বিক্রির সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যের বিক্রি কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে শুধু বিলাসী গাড়ি, সোনার গহনা, দামী প্রসাধনীর বিক্রি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন অর্থনীতির এই বিবর্ণ চেহারাকে মোদী তার ভাষ্যে তা অমৃত কালের স্বর্ণ সময়ে প্রবেশ বলে দাবি করছেন। তাকে একটাই প্রশ্ন করা যায়, মোদীর অমৃতকালের স্বর্ণ সময়ে দেশের ৮০ কোটি মানুষ কেন নিজের খাদ্য জোগাড় করতে পারেন না? এ কেমন অমৃতকাল?
Modi Amritkal
মোদীর অমৃতকালে নেই কাজ, বাড়ে ক্ষুধার্তের ভিড়
×
Comments :0