সম্প্রীতির বাতাবরণ নিয়ে একটা গর্বের জায়গা দীর্ঘদিন লালন করেছে পশ্চিমবঙ্গ। সেই আবহ গড়ে ওঠার এক দীর্ঘ ইতিহাসও আছে। কিন্ত সাম্প্রতিক অতীতে এই গর্বের জায়গাটাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। জীবন-জীবিকা নয়, দৈনন্দিনের সমস্যা নয় এরাজ্যের রাজনীতির কেন্দ্রে বসানোর চেষ্টা হচ্ছে বিভাজনের ভয়ঙ্কর ব্যাধিকে। যে ব্যাধিকে নির্মূল করাই ছিল লক্ষ্য, তাকেই মহাসমারোহে উদ্যাপনে নেমেছে এরাজ্যে তৃণমূল বিজেপি। গোটা দেশেই রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থার আরও উত্থান ঘটাতে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি ভাবাদর্শগত, সাংস্কৃতিক কাঠামো। যার লক্ষ্য নয়া উদারবাদ বিরোধী ক্রমবর্ধমান গণঅসন্তোষকে রোধ করা। দেশ জুড়ে তারই নির্মাণ যজ্ঞ চলছে, আর এরাজ্যে তাতে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে তৃণমূল।
রমজান মাস এখন শেষের দিকে, রমজান শেষে ঈদ, তার পরেই রামনবমী। আর এই উৎসব আবহেই তৃণমূল এবং বিজেপি যেভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে তা এরাজ্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, শুধু এইটুকু বলে হাল ছেড়ে দেবার পরিণতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। পরিস্থিতির বাস্তবতাতেই তাই রাস্তায় থাকার উদ্যোগ সিপিআই(এম)’র, বামপন্থীদের। ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে এরাজ্যে তৃণমূল-বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক উসকানি ঠেকাতে পথে নেমে সম্প্রীতির শিবির করা হবে জানিয়েছে সিপিআই(এম)। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শান্তিপ্রিয় মানুষকে জড়ো করে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় হবে সম্প্রীতির শিবির। বিশেষত সেইসব এলাকায় যেখানে দুই শাসকদল উসকানি দিয়ে উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা বানানোর চেষ্টা করছ। শিবির হবে সেইসব এলাকায় এবং সব অংশের মানুষকে নিয়ে। যাঁরা মানুষের মধ্যে ভাগাভাগি চান না, উৎসবের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান তাঁদের সবাইকে জড়ো করাই উদ্দেশ্য। দুই সম্প্রদয়ের ধর্মীয় উৎসব প্রায় একই সময়ে এমনটা এরাজ্যে এই প্রথম নয়। কিছু বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গে উৎসব মানে ছিল আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, ছিল সম্প্রীতি, কোলাকুলির ঐতিহ্য। কিন্তু গত এক দশকে সেই পরিস্থিতি পালটেছে। সাম্প্রতিক অতীতে বিশেষত রামনবমী ঘিরে গুরুতর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা হয়েছে, বেশ কয়েকটি জায়গায় দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। বিভাজনের উসকানি এখন রাজনীতির মধ্যমণি। আর তাই ভোটের আগে যারা দাঙ্গা করায়, ভোটের পরে একসঙ্গে তারাই আমোদ করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ দাঙ্গা-হাঙ্গামা চান না। এবার রমজান মাসেই ছিল দোল উৎসব। আগে থেকে উসকানি সত্ত্বেও মানুষ কিন্তু শান্তিতে উৎসব পালন করেছেন। পারস্পরিক ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করার প্রতিযোগিতা চলছে বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে। সাধারণ মানুষ তার পক্ষে নয়, তাঁরা জীবন-জীবিকার সুষ্ঠু সুরাহা চান। তার থেকে মানুষ যত দূরে যাচ্ছেন, মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, দুই শাসকই চাইছে সেই আঁচ থেকে নিজেদের বাঁচাতে, তাই তারা ধর্মের নামে ভাগাভাগির রাজনীতি চাইছে।
ভাগাভাগি প্রতিরোধেই সম্প্রীতির শিবির গড়ার আহ্বান। সম্প্রীতির পরিবেশ রক্ষায় বামপন্থীরা অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিকদেরও জড়ো করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ ধারাবাহিক। তবু এপ্রিল মাসের গোড়া থেকে বিভিন্ন এলাকার মানুষ শিবিরে জড়ো হবেন তাঁদের নির্দিষ্ট এলাকার পরিস্থিতি অনুযায়ী, বিশেষত স্পর্শকাতর এলাকায়। আরও সতর্কতার সঙ্গে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সেখানে। যখন অশান্তির শক্তি সক্রিয় তখন শান্তির জন্য রাস্তায় থেকে আরও সরব হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। প্রগতির স্বার্থে, বেঁচে থাকার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাবার স্বার্থেই প্রয়োজন বিভাজনের উসকানিকে প্রতিহত করা।
Harmony Camp
সম্প্রীতির শিবির

×
Comments :0