বাজপেয়ী আমলে কাশ্মীরে রমজান মাসে সংঘর্ষ বিরতির ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা ছিল এখন তিহার জেলে বন্দি জেকেএলএফ নেতা ইয়াসিন মালিকের। শুধু তাই নয়, গোয়েন্দা কর্তাদের ব্যবস্থাপনায় মালিক লস্কর প্রধান হাফিজ সঈদের সঙ্গে দেখা করেছেন আবার একাধিক বার তাঁর কথা হয়েছে দুই শঙ্করাচার্য ও আরএসএস নেতাদের সঙ্গে। ভি পি সিং থেকে মনমোহন সিং, কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ৭জন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। এখন রাজনৈতিক স্বার্থে বিজেপি ওকে সন্ত্রাসবাদী বানিয়েছে। দিল্লি হাইকোর্টে পেশ করা হলফনামা জেকেএলএফ নেতা ইয়াসিন মালিক এমনই বিস্ফোরক সব মন্তব্য করেছেন। ওই হলফনামায় বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য জানিয়েছেন।
জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) নেতা ইয়াসিন মালিক দিল্লি হাইকোর্টে দাখিল করা এক বিস্তারিত হলফনামায় এমন একাধিক দাবিই করেছেন। বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনডিটিভি’র হাতে আসা ওই নথি মালিকের দুই দশকের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলাপআলোচনার বিবরণী হিসাবে উঠে এসেছে। হলফনামা দিয়ে মালিক জানিয়েছেন, ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরের (আইবি) এক শীর্ষ আধিকারিকের নির্দেশে তিনি লস্কর-ই-তৈবা প্রধান হাফিজ সঈদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। কাশ্মীর শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী শুরু করা এবং মনমোহন সিং চালিয়ে যাওয়া আলোচনাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই এই সাক্ষাৎ— দাবি মালিকের।
৮১ পৃষ্ঠার ওই হলফনামায় মালিক উল্লেখ করেছেন, দিল্লিতে পাকিস্তান সফরের আগে আইবি-র স্পেশাল ডিরেক্টর ভি কে যোশী তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে ২০০৫ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ত্রাণ সংগ্রহের লক্ষ্যে পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই সঈদ-সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী নেতার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন মালিক। দেশে ফিরে দিল্লিতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণনের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে সম্পূর্ণ রিপোর্টও দেন। তখনকার আইবি স্পেশাল ডিরেক্টর ভি কে যোশী তাঁকে নির্দেশ দেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকে বিজেপি রাজনৈতিক স্বার্থে “সন্ত্রাসবাদী যোগ” হিসেবে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ তাঁর।
মালিক বলেছেন, ১৯৯০-এ প্রথম গ্রেপ্তারের পর থেকে ভি পি সিং, চন্দ্রশেখর, পি ভি নরসিংহ রাও, এইচ ডি দেবেগৌড়া, আই কে গুজরাল, অটল বিহারী বাজপেয়ী ও মনমোহন সিং— মোট সাত প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি। হলফনামায় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গেও একাধিক গোপন বৈঠকের উল্লেখ রয়েছে।
নথিতে তিনি উল্লেখ করেছেন— দুই ভিন্ন মঠের অন্তত দু’জন শঙ্করাচার্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছে। তিনি আরএসএস নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, আলোচনা করেছেন ভারতীয় গোয়েন্দা আধিকারিকদের সঙ্গেও এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ২০০০-০১ সালের রমজান সংঘর্ষ বিরতিতে তাঁর ভূমিকার কথাও জানিয়েছেন ইয়াসিন মালিক। তবে মালিক যেসব নেতা ও সংগঠনের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের কারও পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া আসেনি।
মালিকের দাবি, শ্রীনগরে তাঁর বাড়িতে অন্তত দু’জন শঙ্করাচার্য “অসংখ্যবার” গিয়েছেন এবং এমনকি তাঁর সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনও করেছেন।
তিনি লিখেছেন: “দুই ভিন্ন মঠের দুই শঙ্করাচার্য আলাদাভাবে একাধিকবার আমার বাড়িতে এসেছেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনও করেছেন। এটা কি বিস্ময়ের নয় যে গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত একজনের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি প্রকাশ্যে মঞ্চ ভাগ করেছেন?” তবে তিনি কোন শঙ্করাচার্য বা কবে কবে তাঁরা শ্রীনগর সফর করেছেন— তা স্পষ্ট করেননি।
মালিক দাবি করেছেন, ২০১১ সালে দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে আরএসএস নেতাদের সঙ্গে তাঁর পাঁচ ঘণ্টার “ম্যারাথন বৈঠক” হয় তার বন্দোবস্ত করেছিল দিল্লি ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর ডায়লগ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন (সিডিআর)।
তিনি দাবি করেছেন, ২০০১ সালে বাজপেয়ী সরকার তাঁকে পাসপোর্ট দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীরের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে বৈধ ভিসায় সফর করে ‘অহিংস গণতান্ত্রিক সংগ্রামের’ পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন তিনি।
হলফনামায় আরও উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, ১৯৯০-এ এয়ার ফোর্স কর্মী হত্যা, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিতাড়ন, সন্ত্রাসবাদী তহবিল— এনআইএ-র সমস্ত অভিযোগই মিথ্যা। তাঁর বক্তব্য, বিজেপি সরকার ২০১৯-এর পর শান্তি প্রক্রিয়া ভেঙে দিয়ে ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করেছে।
মালিকের দাবি, “আমাকে শান্তির দূত হিসেবে দেখা উচিত ছিল। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমাকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে দমন করা হচ্ছে।”
এছাড়া, বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে অ্যাডমিরাল কে কে নায়ার, যিনি তখন বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন, তাঁকে তিনি একাধিকবার দুপুরের খাবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন— কখনও নিজের বাড়িতে, কখনও ওই সেন্টারে।
মালিকের আরেক দাবি, ২০০০-০১ সালে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর একতরফা রমজান সংঘর্ষ বিরতিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি জানান, দিল্লিতে অজিত ডোভাল তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন তখনকার আইবি ডিরেক্টর শ্যামল দত্ত এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রের সঙ্গে। তাঁরা মালিককে আশ্বস্ত করেন যে প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে আন্তরিক এবং সংঘর্ষ বিরতিকে সমর্থন করতে তাঁকে উৎসাহ দেন।
অন্যদিকে, বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ আর কে মিশ্র তাঁকে দিল্লির বাড়িতে আতিথ্য দেন এবং ব্রেকফাস্ট বৈঠকে ব্রজেশ মিশ্রের সঙ্গে পরিচয় করান।
মালিকের দাবি, তিনি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জেকেএলএফ সাধারণ সম্পাদক রফিক দারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিল প্রধান সৈয়দ সালাউদ্দিনের সঙ্গে ফোনালাপের ব্যবস্থা করেন। সেখানে তিনি সালাউদ্দিনকে সংঘর্ষ বিরতিকে স্বাগত জানাতে বলেন, তবে শর্ত রাখেন যে এর পর অবিলম্বে নিঃশর্ত আলোচনা শুরু করতে হবে।
তিনি আরও জানান, কাশ্মীরে হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করে সৈয়দ আলি শাহ গিলানি, আব্দুল গনি লোন, মীরওয়াইজ উমর ফারুক, আব্বাস আনসারি প্রমুখ এক যৌথ বিবৃতিতে সংঘর্ষ বিরতিকে সমর্থন করেন— শর্তসাপেক্ষে।
মালিক দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এল কে আদবানি তাঁর শান্তি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন এবং ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো তাঁকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়। এরপর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে সফর করেন এবং “অহিংস গণতান্ত্রিক সংগ্রামের” পক্ষে বক্তব্য দেন।
মালিকের এই সব দাবি আদালতে জমা দেওয়া হলফনামার অংশ মাত্র। এখনো পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সংগঠন এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
Comments :0