Abhishek Banerjee

দীর্ঘ জেরায় এজেন্ট চক্র নিয়ে প্রশ্নের মুখে অভিষেক

রাজ্য কলকাতা

Abhishek banerjee cbi recruitment scam bengali news

জেলায় জেলায় এজেন্ট চক্র তৈরি করেই টাকা তোলা হয়েছে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে। সেই টাকা নানান স্তর পেরিয়ে পৌঁছে যেতো শীর্ষ মহলে, তদন্তের প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
শনিবার নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তের প্রথম বারের জেরায় সেই এজেন্ট চক্র নিয়েই দফায় দফায় প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে অভিষেক ব্যানার্জিকে। 

কুন্তল ঘোষ যেমন এজেন্ট হিসাবে কাজ করত তেমনই ধৃত হুগলীর তৃণমূল নেতা শান্তনু ব্যানার্জি, ধৃত মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়কও মেরিট লিস্ট থেকে টাকা তোলা— গোটা প্রক্রিয়াতেই যুক্ত ছিল। তদন্তে ইতিমধ্যে উঠে আসা এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে তৃণমূল সাংসদ, মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর যোগসূত্র কী ছিল— নিজাম প্যালেসের ১৪ তলায় একের পর এক প্রশ্নের মুখেই পড়তে হয়েছে তাঁকে। 

সকাল এগারোটা থেকে রাত আটটা চল্লিশ— প্রায় সাড়ে নয় ঘণ্টার জেরা শেষে বাইরে বেরিয়ে এলেন অভিষেক ব্যানার্জি। নিজাম প্যালেসের গেটের সামনেই পুলিশের তরফে আগেই মাইক, বক্সের আয়োজন করা হয়েছিল। 
নিজাম প্যালেস চত্বরেই পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মীদের ঘেরাটোপে মাইক হাতে রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে কার্যত এজেন্ট চক্র নিয়ে জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল তা প্রকারান্তরে স্বীকার করেই অভিষেক ব্যানার্জি দাবি করেন, ‘ভিতরে কী কথা হয়েছে তা সবটা তো বলব না। তবে তদন্তকারী যে সব নাম ধরে আমি তাদের চিনি কি না জানতে চেয়েছেন তার বেশিরভাগটাই পূর্ব মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ। এটুকু বলতে পারি আমার কাছে যে নাম জানতে চাওয়া হয়েছে তার ৯০ শতাংশ পূর্ব মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদের। তাহলে সেই সময় এই দুই জেলার দায়িত্বে দলের থেকে কে ছিল ? কে দেখত ঐ দুই জেলা? তাঁকে কেন জেরা করা হবে না?’

নাম না তুললেও অভিষেক ব্যানার্জির ইঙ্গিত স্পষ্ট— শুভেন্দু অধিকারী। বর্তমানে বিজেপি নেতা, রাজ্য বিধানসভার এই বিরোধী দলনেতা ২০২০ পর্যন্ত তৃণমূলের দাপুটে নেতা ছিলেন। ২০২৩-তে এসে বর্তমান তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ দাপুটে নেতা সিবিআই জেরা থেক বাইরে বেরিয়ে ইঙ্গিত করছেন দুর্নীতি চক্র যে দুই জেলায় ফুলেফেঁপে উঠেছিল দক্ষিণবঙ্গের সেই দুই জেলার দায়িত্বে ছিলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা, বর্তমান বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী।

ফলে মুখ্যমন্ত্রী থেকে অভিষেক ব্যানার্জি— মাঠে ময়দানে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বাজার গরম করার অভিযোগ আনলেও সিবিআই জেরার পরে অভিষেক ব্যানার্জির এমন দাবি থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট। 
দলীয় বাহিনীকে চাঙা রাখতে যাই বলা হোক না কেন অভিষেক ব্যানার্জি নিজাম প্যালেসে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে যা দাবি করলেন তাতে স্পষ্ট— নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছে তৃণমূল আমলেই। তাঁর পিসি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই নিয়োগ দুর্নীতির শুরু। সেই সময় তৃণমূলের নেতা হিসাবে পূর্ব মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদ দেখতেন শুভেন্দু অধিকারী। তৃণমূল নেতা হিসাবেই তিনি এই দুই জেলা থেকে টাকা তুলেছেন। এখন বিজেপি-তে গেছেন বাঁচতে। 

দ্বিতীয়ত, দলীয় বাহিনীকে চাঙা রাখতে নানান যুক্তিহীন,অবাস্তব অভিযোগ আনলেও সিবিআই জেরায় নিয়োগ দুর্নীতিতে কোনভাবে সিপিআই(এম)-কে জড়াতে পারেননি। প্রাক্তন তৃণমূলকেই দায়ী করতে হয়েছে। ফলে তাঁদের সরকারের আমলেই দুর্নীতি হয়েছিল তা নিজাম প্যালেসে দাঁড়িয়েই মানতে হয়েছে ভাইপো সাংসদকে।

যদিও জেরা শেষে ‘বাড়তি আত্মবিশ্বাস’ দেখিয়ে অভিষেক ব্যানার্জি সিবিআই জেরায় অশ্বডিম্ব প্রসব হয়েছে বলে দাবি করে বলেন, এই জেরার নির্যাস শূন্য। যারা ডেকেছে তাঁদের সময় নষ্ট,আমারও সময় নষ্ট। ৯০ শতাংশ প্রশ্নই বোগাস। পরে জানা যাবে। এরপরে কার্যত রাজনৈতিক বক্তৃতাই দিয়েছে নিজাম প্যালেসের বাইরে পুলিশের আয়োজনে এই সাংবাদিক বৈঠকে। তবে সিবিআই’র দাবি একাধিক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথন, মেসেজের প্রমাণ সামনে রাখলেও তা অস্বীকারের পথেই হেঁটেছেন তৃণমূলের এই শীর্ষ নেতা।

তবে শুধু কুন্তল ঘোষের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে নয়, কালীঘাটের কাকু নিয়ে সকাল থেকে ম্যারাথন জেরায় প্রশ্নবাণের মুখে পড়তে হয়েছে অভিষেক ব্যানার্জিকে। সেই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নে দৃশ্যতা কিছুটা বিরক্ত অভিষেক বলেন, সেই বিষয়ে আপনাদের কিছু বলব না, নির্দিষ্ট জায়গায় উত্তর দিয়েছি। ৯০ শতাংশ প্রশ্ন বোগাস দাবি করলেও কুন্তল ঘোষ থেকে কালীঘাটের কাকু, জেলা জেলায় নিয়োগ দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা তোলার মতো সব বিষয়েই যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তা জানা গেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রেই। 

এর আগে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর আরেক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র জেরার মুখে পড়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি। তবে সেটা ছিল কয়লা পাচারকাণ্ডে, সিজিও কমপ্লেক্সে। তার আগে দুবার দিল্লিতেও জেরার মুখে পড়েছিলেন। তবে সিবিআই জেরা এই প্রথম।

সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই ফের নাটকীয়ভাবে এদিন ভাইপো সাংসদ বলেন— বারেবারে বলছি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে, তথ্য পেলে সেটা প্রকাশ্যে জানান। বারেবারে ডাকতে হবে না। নিজেই ফাঁসির মঞ্চে চলে যাব। কয়লা, গোরু, নারদকাণ্ডের পরে এসএসসি কাণ্ডেও একইকথা বলছি।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ সাংবাদিকদের কাছে এমন দাবি করলেও এদিনের জেরা আটকাতে যেমন শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টে ডিভিসন বেঞ্চ থেকে প্রধান বিচারপতির এজলাসে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন বিচারপতি অমৃতা সিনহার নির্দেশের স্থগিতাদেশের আরজিতে তেমনই এদিনই আবার পরবর্তী তলব ঠেকাতে সুপ্রিম কোর্টে স্পেশাল লিভ পিটিশন দায়ের করেছেন। মূলত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের যে রায় বহাল রেখেছেন অমৃতা সিনহা সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই সুপ্রিম কোর্টে যান অভিষেক। ফলে  জেরা ঠেকানোর সব রকম চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

নিয়োগকাণ্ডে ধৃত কুন্তল ঘোষের বিরুদ্ধ ইডি যে চার্জশিট দায়ের করেছে তাতে স্পষ্ট ২০১২ সাল থেকেই চলেছে প্রাইমারিতে টাকার বিনিময়ে চাকরির খেলা। ২০১২ সাল থেকেই তাতে হাত পাকিয়েছিল কুন্তল ঘোষ। সেই ব্যক্তিকেই ২০২২ সালের নভেম্বরে অর্থাৎ নিয়োগকাণ্ডে পার্থ চ্যাটার্জির গ্রেপ্তারির পরেও কেন যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বানিয়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি? 

একই সঙ্গে ধৃত বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহা  ও ধৃত আরেক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর মোবাইলে কথোপকথনের তথ্য মিলছে বলে দাবি সিবিআই’র। তার ভিত্তিতে লাগাতার প্রশ্নের মুখে বারেবারে তা অস্বীকার করেন অভিষেক ব্যানার্জি। সিবিআই’র দাবি, গোটা জেরা প্রক্রিয়ায় সিংহভাগ প্রশ্নে বিভ্রান্তিকর উত্তর মিলেছে।

Comments :0

Login to leave a comment