Alipurduar rape case

ধর্ষণ-খুনের মামলা মিটিয়ে নিতে পুলিশ পাঠিয়ে ডেকে আনা হলো

জেলা

 আলিপুরদুয়ারে নাবালিকা ধর্ষণ ও হত্যার মামলার নিস্পত্তি বা মীমাংসার জন্য আলিপুরদুয়ার জেলা লিগাল সার্ভিস অথরিটি ডেকে পাঠালো নির্যাতিতার মাকে। মঙ্গলবার তাঁকে উপস্থিত থাকতে বলা হয় আদালতে। শুধু তাই নয়, পুলিশ পাঠিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে চিকিৎসক ও আইনজীবীদের বক্তব্য। প্রশ্ন উঠেছে, পকসো আইনে চলা ধর্ষণ, খুন, প্রমাণ লোপাটের মামলার নিষ্পত্তি সেটেলমেন্ট বা আপসের মাধ্যমে কীভাবে হওয়া সম্ভব। শুধু তাই নয় মামলা হাইকোর্টে দায়ের হওয়ার পরেও কী করে ওই নোটিস জারি হতে পারে- তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী ও চিকিৎসক মহল। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস সহ চিকিৎসকদের সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ জয়েন্ট প্ল্যাটফরম অব ডক্টরস, পশ্চিমবঙ্গ।
একটি নোটিস জারি করে মঙ্গলবার নির্যাতিতার মাকে আদালতে উপস্থিত থাকতে বলেন জেলার আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার নির্যাতিতার মা বলেন, ‘চিঠি পেয়ে আজ আমি গিয়েছিলাম কোর্টে। প্রথমে যাবো না ভেবেছিলাম। কারণ, আর কোনও মামুলি কথাবার্তা বা টালবাহানা চাই না, সোজা কথা এবার আমার ন্যায়বিচার চাই। পরে পুলিশের জোরাজুরিতে যেতে হয়েছিল। আমার সঙ্গে আজকেও আইনজীবীরা ছিলেন। আদালতে আমাকে ঘটনার কথা আবার কিছু কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়। প্রশ্ন করা হয়— এটা যে ধর্ষণ ও হত্যা তা তুমি বুঝলে কী করে। আমার ওই একরত্তি মেয়েটাকে কীভাবে মেরেছে— কী করেছে ওরা তা তো মা হয়ে আমি বুঝতে পারছি। আমি সোজাসাপ্টা সে কথাই বললাম আদালতে। আমাদের একটাই কথা, কোনও দাক্ষিণ্য চাই না, ন্যায়বিচার চাই। এজন্য যতদূর যেতে হয় যাবো।    
লিগাল সার্ভিস কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করে চিকিৎসক সংগঠনের বক্তব্য, এমন নৃশংস মামলায় নিষ্পত্তি চাওয়ার ক্ষেত্রে আইন স্পষ্টভাবে কোনোরকম আপস নিষিদ্ধ করে। সুতরাং এই পদক্ষেপ আইনি এবং নৈতিকতার এক গুরুতর লঙ্ঘন। অবিলম্বে মামলার নিস্পত্তির জন্য চাপ দেওয়া বন্ধ করতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে লিগাল সার্ভিস অথিটির বিরুদ্ধে। একই বক্তব্য আইনজীবী মহলেরও।
গত ৯ আগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অভয়া’র নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাড়া করে বেরাচ্ছে অনেককেই। তারপর রাজ্যজুড়ে পরপর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাক্ষী থেকেছে রাজ্যবাসী। অক্টোবর মাসে জয়গাঁতে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী-এক শিশু সন্তানকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে তোলপাড় হয় আলিপুরদুয়ার জেলা। বেশ কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর ওই শিশু কন্যার পচা গলা মৃতদেহ উদ্ধার হয় একটি ঝোঁপের ভেতর থেকে।  
প্রতিবাদে পথে নামেন চিকিৎসক থেকে আইনজীবী, সমাজকর্মীরা। অভিযোগ ওঠে প্রমাণ লোপাটের। অভিযুক্ত কয়েকজনকে পুলিশ নেপাল থেকে গ্রেপ্তার করলেও কোন শাস্তি এখনো পর্যন্ত হয়নি। মামলা গড়ায় আলিপুরদুয়ার আদালতে। ঘটনায় উদ্বেগ জানান সবাই। পুলিশের কাজে গাফিলতি নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে তদন্তকে প্রভাবিত করা নিয়েও। এরপর এই মামলা যায় কলকাতা হাইকোর্টে। 
মঙ্গলবার এক প্রেস বিবৃতিতে জয়েন্ট প্ল্যাটফরম অব ডক্টরস, পশ্চিমবঙ্গের যুগ্ম আহ্বায়ক ডাঃ পুন্যব্রত গুন ও ডাঃ হীরালাল কোনার বলেন, এই অপরাধটিও সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা ১৩৭ এবং ১৪০-এর অধীনে মামলা শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে, বিএনএস-এর ধারা ৭০, ১০৩, ৬১ এবং ২৩৮-এর অধীনে আরও গুরুতর অভিযোগ এবং পকসো আইনের ধারা ৬ যুক্ত করা হয়, যা অপরাধের নৃশংস প্রকৃতিকে প্রকাশ করে। এটি কেবল একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ নয়, বরং সমাজের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর এবং ক্ষমাহীন অপরাধ। চিকিৎসকরা বলেন, ধর্ষণ, হত্যা এবং প্রমাণ ধ্বংসের মতো নৃশংস অপরাধগুলি আইনের অধীনে সমঝোতা করা যায় না এবং এই ধরনের মামলাগুলি সমঝোতা করে নিষ্পত্তি করার যে কোনও প্রচেষ্টা ন্যায়বিচার এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি সরাসরি আঘাত বলেই গণ্য হয়। নির্যাতিতার মা পুলিশ দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার ফলে তিনি রাজ্য পুলিশের প্রতি আস্থা হারিয়ে একটি স্বাধীন তদন্তের জন্য হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
এএইচএসডি’র সাধারণ সম্পাদক ডাঃ উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়, আইনজীবী শামিম আহমেদ প্রমুখ বলেন, যে সংগঠিত অপরাধ গোটা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে, তা সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ (ক্রাইম এগেইনস্ট সোসাইটি) বলে গণ্য হয়। এই পরিস্থিতিতে লোক আদালত বসিয়ে মীমাংসার অভিসন্ধিটাই অপরাধের মধ্যে পড়ে। উপরন্তু হাইকোর্টে যে মামলা দায়ের হয়েছে তার এইভাবে আপোষ মীমাংসার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই যিনি ওই নোটিস ইস্যু করেছেন, তিনিও অপরাধী। টাকা দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে আপসে কোনোভাবে রাজি নয় বলেই তো নির্যাতিতার পরিবার হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন, মামলাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। 
তীব্র নিন্দা জানিয়ে চিকিৎসকরা এদিন পাঁচ দফা দাবি তুলে বলেন, যে কোনও প্রভাব থেকে মুক্ত একটি নিরপেক্ষ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ  তদন্ত পরিচালনা করা হোক। যাঁদের নির্দেশে মামলাটি নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে হবে এবং অবৈধ নিষ্পত্তির প্রস্তাব দিয়ে ন্যয়বিচারকে ব্যাহত করার চেষ্টা যারা করেছেন সেই  কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। দাবি, প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সুরক্ষা প্রদান করে নির্যাতিতার পরিবারের সমস্ত ধরনের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। মামলার নিষ্পত্তির জন্য চাপ দেওয়া বন্ধ করতে সমস্ত পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও দাবি জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
 

Comments :0

Login to leave a comment