উজ্জ্বল দাস: খানাকুল,
বিজেপি-তৃণমূল একসাথে পঞ্চায়েত চালাচ্ছে। কোথাও তৃণমূলের প্রধান, বিজেপি’র উপপ্রধান; আবার কোথাও উল্টোটা। মিলেজুলেই চলছে দুর্নীতি। গরিবের দিকে দেখার কোনও সময় নেই তাদের। আবার সিপিআই(এম)’র বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে বিজেপি-তৃণমূল এক। ২০০৯ সাল থেকে খানাকুল পার্টি অফিসে পাঁচবার হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। এখন বিজেপিও হুমকি দিচ্ছে।
খানাকুলের রামমোহন-১, ঠাকুরানিচক, খানাকুল ২ পঞ্চায়েতের মানুষ বলছেন, ভুল করেছিলাম। মস্ত বড় ভুল। চোর তাড়াতে যাকে ডেকে আনলাম এ তো দেখি ডাকাত! তৃণমূলের লাগাতার সন্ত্রাসের মুখে টিকতে না পেরে ভেবেছিলাম বিজেপি’র হাত ধরলে কিছুটা রেহাই পাব। কিন্তু এ তো দেখি একটা মুখ আর একটা মুখোশ! দু’দল মিলেই লুটে পুটে খাচ্ছে সব। দেখে, শুনে অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন তাই আর ভুল নয়, অনেক শিক্ষে হয়েছে। এবার ভুল সংশোধন করতে হবে।
গোঘাট, খানাকুল ১ ও ২নম্বর ব্লকের গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দেখা গেল বাড়িতে শুধুমাত্র বয়স্ক কিছু মানুষ আর মহিলাদের। ভোটের মুখেও গ্রামে দেখা নেই যুবকদের। গোঘাটের নবাসন গ্রামের রাজু কুণ্ডু জানালেন, আমাদের প্রজন্মই শেষ। চাষে আর নতুন কেউ আসছে না। আসবেই বা কেন? জমিতে হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও লাভের মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
টিনের চারচালা বাড়ির ঘরের দেওয়ালগুলো মাটির। বারান্দায় লাল সিমেন্ট করা মেঝেতে মাদুর পেতে বসালেন। শোনালেন চাষের গল্প। ঠাকুরদার আমলের ৪২ বিঘে জমি কমতে কমতে এখন ১৬ বিঘে। সেই জমিতে বছরে তিনবার চাষ করেন। ধান, আলু আর তিল। মুনিশের পাশাপাশি নিজেও গতর নিংরানো পরিশ্রম করেন। তাতে বছরভর দু’বেলা অন্নটুকু জোটে। মেয়ের বিয়ে দিতে, ঘর পাকা করতেও জমি বেচতে হয়।
কৃষক অনিল মণ্ডল জানালেন, তাঁর ৭ বিঘে জমি আছে। প্রতি বিঘা জমিতে আমন চাষ দিতে খরচ হয় ২৫০ টাকার বীজ, ১৪০০ টাকার জল, ১৮০০ টাকার ট্রাক্টর, ২৫০০ টাকার সার, ৩০০০ টাকার কীটনাশক, ৫০০০ টাকা মুনিশ, আর জমি থেকে ধান তুলে আনার খরচ বাবদ ২০০০ টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫৯৫০ টাকা। গড়ে বিঘে প্রতি ধান পাওয়া যায় ২৫ মন বা ১০ কুইন্টাল। বিক্রি করে মেলে ২১,০০০ টাকা। কিন্তু আলু চাষের খরচ আরও বেশি। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় পরপর ক্ষতি হচ্ছে আলু চাষে। বিঘে প্রতি ৩৩,৭০০ টাকা আলু বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২৪ হাজার টাকা। ধানের সব লাভটাই ঢুকে যাচ্ছে আলু চাষে। তাই নতুন প্রজন্মের কেউ আর চাষে আসছে না। তারা চলে যাচ্ছে বাইরের রাজ্যে সোনা, জরি বা নির্মাণ শিল্পের শ্রমিক হিসাবে।
লাভ না হলে চাষ করেন কেন? উত্তরে অনিল মণ্ডল জানালেন, জমি বাঁচানোর জন্যই চাষ করা। আর চাষ না করলে অন্যের জমিতে মুনিশ খাটতে যেতে হবে। তার থেকে নিজের জমিতেই মুনিশ খাটি। বাড়ির মেয়ে-বৌ সকলকেই তাই চাষের কাজে লাগাতে হয়েছে। তাই মুনিশ খরচের একটা অংশ ঘরে থেকে যায়। তবে জমিতে আলু তোলার পর তিল চাষ করলে খরচটা একটু কম হওয়ায় তিল বিক্রি করে কিছু টাকা ঘরে আসে।
খানাকুল ১ ব্লকের পোল গ্রামের নাসিরুদ্দিন খান, রুহুল আমিন খান, সৈয়দ আলি খানেরা জানালেন, কিষান মান্ডিতে ধান বিক্রির অভিজ্ঞতার কথা। কৃষক সরাসরি ধান বিক্রি করতে গেলে টোকেন মেলে মাত্র ২৫ কুইন্টালের। তা থেকে ধলতা বাদ দেয় কুইন্টাল প্রতি ১০ কেজি। অথচ ওই টোকেন নিয়েই ফড়েরা ধান বিক্রি করতে গেলে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৪৫ কুইন্টাল। ছাড় মেলে ধলতাতেও। সরকার ধানের সহায়ক মূল্য বেঁধে দেওয়ায় তবু মহাজনেরা তার কাছাকাছি একটা দামে ধান কেনে। কিন্তু আলুর দাম বেঁধে না দেওয়ায় দামের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। তাই আলু চাষিরা চরম ক্ষতির মুখে পড়ছেন। এভাবে চললে আগামী দিনে কেউই আর চাষ করবে না। সব কিছুই কি তখন বাইরে থেকে আমদানি করা হবে? প্রশ্ন করেন তাঁরা।
খানাকুলের সিপিআই(এম) নেতা ভজহরি ভুঁইয়া বলেন, খানাকুলের কৃষকেরা একদিকে বর্ষায় বন্যায় ডুবে থাকে। মার খায় চাষ। আবার গ্রীষ্মে বোরো চাষের সময় সেচের জল পান না। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের ডিপ টিউবওয়েলগুলো খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। সারানোর কোনও উদ্যোগ নেই দায়িত্বে থাকা তৃণমূলীদের। আগে মুণ্ডেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর ও দামোদর নদীতে বর্ষা শেষে বোরো বাঁধ দিয়ে সেখানে জল জমিয়ে রেখে স্লুইস গেটের মাধ্যমে চাষের জমিতে পাঠানো হতো। এখন সেসব অতীত। কেউ দেখে না।
রামমোহন-২, তাঁতিশাল, বালিপুর, রামমোহন-১, অরুন্ডা, পলাশপাই-১, চিংড়া, সাবর সিংহপুর, নতিবপুর-১, মারোখানা গ্রামগুলি বন্যা প্রবণ। প্রায় প্রতি বছর বন্যায় ডুবে যায়। নদীগুলির নাব্যতা কমে যাওয়ায় জলধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। বাঁধগুলি নিয়মিত দেখভালের অভাবে জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়ছে। ফি বছর বর্ষায় মুণ্ডেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর গিলে খাচ্ছে দু’ধারের বাড়ি, চাষজমি। সাংসদ, বিধায়ক, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি-কেউই নজর দেন না। সিপিআই(এম) আন্দোলন গড়ে তুলছে। মানুষকে একজোট করছে। লাল ঝান্ডার থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষেরা ভয়-ভীতি ভেঙে ফিরছে। মিছিল-সমাবেশে ভিড় বাড়ছে। ১৩ বছর যে গ্রামগুলোতে পার্টি কর্মীদের ঢোকায় ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেছিল শাসকদল সেই সব গ্রামেও এবার লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থী প্রচারে গেছে। সভা করা হয়েছে। তাই এখন কেন্দ্র-রাজ্যের দুই শাসক দলেরই চক্ষুশূল লাল ঝান্ডা।
আরামবাগ কেন্দ্রের বামফ্রন্ট প্রার্থী বিপ্লব কুমার মৈত্র পায়ে হেঁটে সমস্ত এলাকা চষে ফেলেছেন লাল ঝান্ডার কর্মীদের নিয়ে। তিনি বলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে গ্রামেই শিল্প স্থাপন, খানাকুলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ভাঙন, কৃষির চরম সঙ্কটের কথা তুলে ধরেই মানুষের কাছ থেকে বিপুল সাড়া পাচ্ছেন তিনি প্রচারে।
Comments :0