Brick Kiln crisis

জিএসটি’র চাপে ধুঁকছে ইটভাটা, বন্ধের শঙ্কায় সুনাল মুণ্ডারা

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

 

দীপাঞ্জনা দাশগুপ্ত দে

পশ্চিমবঙ্গে বেঁচে থাকা যে গুটি কয়েক শিল্প আছে তার মধ্যে অন্যতম ইট শিল্প। গঙ্গার ধার ধরে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা ইট ভাটাগুলো এক সময় ভারতের নির্মান শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার আছিপুর এমনই একটি জায়গা। যেখানে গঙ্গার ধার ধরে সারি দিয়ে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। তবে আছিপুরের ইট ভাটাগুলো নতুন নয়। সত্তরের দশক থেকেই এখানে গড়ে উঠেছিল একের পর এক ইটভাটা। বজবজ স্টেশন থেকে অটো করে প্রায় চল্লিশ মিনিট যাওয়ার পরে গঙ্গার ধারে পুজালী পৌরসভার অন্তর্গত আছিপুর।

অটো থেকে নামলেই দেখা যায় ইট ভাটার চিমনি গুলো থেকে লাগাতার উঠছে ধোঁয়া। কিন্তু বর্তমানে যথেষ্ট সঙ্কটে এই শিল্প। তার পেছনে নানা কারণ থাকলেও বর্তমানে অন্যতম প্রধান কারণ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চাপিয়ে দেওয়া পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি চলতি বছরেরই জিএসটি’র হার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১২শতাংশ ফলে বড় সমস্যার মুখে পড়েছে ইট ভাটা শিল্প। বর্ধিত জিএসটি’র জেরে সরকারকে প্রতি ৯ লক্ষ ইটে প্রায় ১৬ লক্ষ টাকা জিএসটি দিতে হচ্ছে ভাটা মালিকদের সঙ্কটের আঁচ পড়ছে শ্রমিকদের ওপর। 

দক্ষিণ ২৪ পরগনা টালি ইট ভাটা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সম্পাদক শাহনওয়াজ কাজি বলছেন, ‘‘এভাবে জিএসটি বাড়ানোয় সঙ্কটে পড়ছে এই শিল্প। মালিকরা কাজ বন্ধ রাখছে। ফলে তীব্র সমস্যায় পড়ছেন শ্রমিক এবং কর্মীরা।’’

নভেম্বর মাসে ইট ভাটায় কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মালিকপক্ষ। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল শ্রমিকদের ওপর। কোপ পড়েছিল তাদের আয় রোজগারে পথে। কিন্তু সরকারের তরফে জিএসটি না কমালে ভাটা চালিয়ে উৎপাদন করা সম্ভব নয় বলে পাল্টা জবাব দিয়েছিল মালিক পক্ষ। এই পরিস্থিতিতে চরম সঙ্কটে পড়েন দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিকরা, যাঁদের অধিকাংশই ভিন রাজ্যের। 

ঝাড়খণ্ড থেকে ইন্ডিয়ান ব্রিকসে কাজ করতে আসা পরিযায়ী শ্রমিক সুনাল মুণ্ডা জানান ‘লকডাউনে আমাদের কাজ ছিল না, রোজগারও ছিল না। তিন চার মাস সরকারি সাহায্যও পাইনি তেমন। করোনার দু’বছর খুব কষ্টেই কেটেছে। বছরের এই সময়টা কলকাতায় আসি ইট ভাটায় কাজ করতে। কিন্তু সেটাও এসে জেনেছি মালিক পক্ষ বন্ধ রাখছে। তাহলে আমরা কোথায় যাব। আমরা কী খাব?’ 

 

 

 

নরম মাটির তাল নিয়ে ফর্মার মধ্যে ফেলে একের পর এক কাঁচা ইট রাখতে রাখতে সুনাল বলে চলছিলেন, ‘জমানো কিছু আমাদের নেই। কাজ করে যা আয় করি তাই খাই। ভাটা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা তো না খেয়ে মরব। ’

টানা ধর্মঘটের পর যখন সরকারে কোনও হেলদোল ছিল না সেই সময় অল ইন্ডিয়া ব্রিক অ্যান্ড টাইল ম্যানুফ্যাকচ্যারিং ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সঙ্গে দেখা করে জিএসটি কমানোর আর্জি জানিয়েছিল সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। অর্থমন্ত্রী জিএসটি কমানোর বিষয়টি ভাবনা চিন্তা করবেন বলে আশ্বাস দিলেও আজও তা কমেনি। 

আছিপুর, রাজিপুর পূজালী ইট ভাটা মালিক সংগঠনের সভাপতি নবীন মণ্ডল জানান, ‘‘তৈরি হওয়া ইটের ওপর জিএসটি বাবদ আমরা যে টাকা দিচ্ছি আগেই তা ২৪০ শতাংশ বেড়েছিল। এখন আরও বেড়ে ৬০০ শতাংশ বাড়তি টাকা দিচ্ছি। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরির ওপরও বসেছে ১২ শতাংশ জিএসটি। এছাড়াও ব্যাপক হারে বেড়েছে কয়লার দাম। বছর খানের ধরে প্রায় ৩৫০ শতাংশ বেড়েছে কয়লার দাম’’ এই পরিস্থিতিতে ইট ভাটাগুলো চালানোই মালিকদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি। সরকার যদি জিএসটির হার ও কয়লার দাম না কমায় তা হলে একে একে বন্ধ হয়ে যাবে ইটভাটা, বলছেন নবীন মন্ডল। 

 

ইটভাটাগুলোর জন্য পরিবেশ দূষিত হয় এরকম অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু কাজ চালনো জন্য সরকারি সর্ত মেনে যতটা চলা সম্ভব তা করা হয়েছে বলে দাবি মালিকদের। ধুলো, কাদা, মাটি নিয়ে ক্রমাগত কাজ করায় নানা শারীরিক সমস্যা হয় ইটভাটার শ্রমিকদের। সিআইটিইউ’র লাগাতার আন্দোলন চাপে পরে শ্রমিকদের জন্য বেসরিকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করেছে মালিকপক্ষ। তবে শ্রমিকরা যেন ইএসআই’র মাধ্যমে চিকিৎসা পান তার লাগাতার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে শ্রমিক সংগঠনগুলি

মালিক পক্ষের দাবি, শুধু পরিবেশের দোহাই দিয়ে নয় স্থানীয় ইটভাটা শিল্প বন্ধ করার পেছনে সরকারের একটা চক্রান্ত আছে। লাল ইটের ব্যবহার বন্ধ করে অ্যাশ ব্রিক বা চলতি ভাষায় ‘সিমেন্ট ইট’ চালু করা। এমনিতেই এখন হাজার স্কোয়ার ফিটের বাড়ির ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে লাল ইট ব্যবহার করা যায় না। সেক্ষেত্রে অ্যাশ ব্রিককেই প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার। মালিকদের আরও দাবি আগের থেকে অনেক কমেছে লাল ইটের ব্যবহার। ছোট ছোট বাড়ি নির্মানের ক্ষেত্রে এবং সরকারি প্রকল্পে কিছু লাল ইট ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বড় বড় কাজে এখন অ্যাশ ব্রিকই ব্যবহৃত হচ্ছে।  

 

 

জিএসটি বৃদ্ধি ও কয়লার দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে সারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের মতো আন্দোলনে সংগঠন করছে ইট ভাটা মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন। এই প্রসঙ্গে শাহনওয়াজ কাজি বলেন ‘‘ইটভাটা গুলো প্রান্তিক ও পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে একটা বড় আয়ের উৎস। সরকার যদি এভাবে কর চাপিয়ে দেন তা হলে মালিকপক্ষ এক এক করে ভাটা গুলো বন্ধ করে দেবে। তাতে যেমন ইট ভাটা শিল্প একটা বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তেমনি বহু শ্রমিকের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।’’ 

কাজি বলছেন, ‘‘এই আছিপুর, পুজালী পৌরসভা এলাকার মধ্যে আছে প্রায় ১৬টি ইট ভাটা একটি বন্ধ থাকায় বর্তমানে চালু ভাটা ১৫টি। তাতে কাজ করে স্থায়ী অস্থায়ী সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। ভাটা গুলো বন্ধ হয়ে গেলে এরা কোথায় যাবে?’’   

 

 

 

এমনিতেই ইট ভাটা গুলোতে বছরের মাত্র কয়েক মাস কাজ হয়। মূলত বর্ষার সময় অর্থাৎ মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে ভাটা গুলো। অক্টোবর নভেম্বর থেকে কাজ শুরু হয়। সেখানে ভিন রাজ্য থেকে কাজ করতে আসে বহু পরিযায়ী শ্রমিক। ঝাড়খণ্ড থেকে আসে পরিযায়ী শ্রমিকরা। অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত কাজ করে আবার তারা অন্যত্র চলে যায় কাজের সন্ধানে। এছাড়াও স্থানীয়রাও কাজ করে। এই সব ইটভাটা বন্ধ হয়ে গেলে এই পুরো ব্যবস্থাপনাটাই শেষ হয়ে যাবে। 

  

Comments :0

Login to leave a comment