প্রিয়াঙ্কা ঘোষ: জাঙ্গিপাড়া
৮ জুলাই। সন্ধ্যা। জাঙ্গীপাড়া ব্লকের রাজবলহাট ২নম্বর পঞ্চায়েতের ২৬ নম্বর বুথ, রহিমপুর পশ্চিমপাড়া প্রাইমারি স্কুল। সন্ধ্যা ৬টা বাজতেই স্কুলের গেটে পদ্মফুলের মদ্যপ জমায়েত, অধিকাংশই অচেনা মুখ। টিভির চ্যানেল থেকে খবরের কাগজ এদিকে রোজ জানান দিচ্ছে বিজেপি’র নাকি পয়লা নম্বর বিরোধী তৃণমূল! শুধু গেটের বাইরে দাঁড়ানো লাঠি হাতের রাজ্য পুলিশ নয়, বাইরে তৃণমূলের জমায়েতও তখন গেট ভাঙতে উদ্যত।
‘এই বুথে আমরা কমজোরি, হারাতেই হবে সিপিএম’কে, তোরা ঢোক, ছাপ্পা দে’, তার সঙ্গে ছাপার অযোগ্য গালিগালাজ তৃণমূলের জমায়েত থেকে। বুথে তখন আমি একা, আমাদের আর কোনও এজেন্ট নেই। ভাবছি শুধু কি করে আটকানো যাবে এই মদ্যপ ছাপ্পাবাজদের। আমার পাশে বসা আমার বুথের তৃণমূলের মহিলা প্রার্থী নিশ্চুপ। হইহই করে দুমিনিটের মধ্যে বুথের মধ্যে ঢুকে পড়ল বিজেপি’র মাতাল বাহিনী, হাতে ভোটার স্লিপ শুধু। বাইরে থাকা ভোটার, মৃত মানুষের ভোট দেবে তারা। প্রিসাইডিং অফিসার অসহায়, তাঁর কলার ধরে চলছে হুমকি। রুখে দাঁড়ালাম, যা হওয়ার হোক, নাহলে আটকানো যাবে না ছাপ্পা। ওরা ১৫/১৬জন, মদ্যপ আর এদিকে আমি একা। তৃণমূলের প্রার্থী আমাকে বলে যাচ্ছে, ‘দিদি ছেড়ে দাও, ওরা ভোট দিচ্ছে দিক’! চটে ঘেরা জায়গার সামনে উঠে দাঁড়ালাম, ‘ভোট দিতে হলে আমাকে আগে মেরে ফেলো’, আমাকে দেখে উঠে এসেছেন প্রিসাইডিং, পোলিং অফিসাররাও। পনেরো মিনিট তুমুল হই হট্টগোলের পর শেষে পিছু হটলো ছাপ্পাবাজরা।
আর হ্যাঁ, বাইরে থাকা আমাদের কমরেডরা ফোনের পর ফোন করে গেছেন সেক্টর অফিসার, স্পেশাল অবজার্ভার, থানায়, ফোর্স পাঠানোর জন্য। বলাই বাহুল্য, কোনও ফোর্স এসে পৌঁছয়নি বুথে!
ভোট মেটার পর গণনার প্রস্তুতি। আমাদের আশঙ্কা ছিল যে গণনা লুট করতে পারে তৃণমূল। পার্টি নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণনার আগের দিনই আমাদের জাঙ্গীপাড়া ব্লকের সব প্রার্থী, কাউন্টিং এজেন্টরা চলে আসেন জাঙ্গীপাড়া এরিয়া পার্টি অফিসে। সন্ধ্যা থেকে চলতে থাকে গণণার প্রয়োজনীয় কাগজ, ফর্ম পূরণের প্রস্তুতি। গ্রামের মানুষরা এনেছেন চাল, আলু সয়াবিন। পার্টি অফিসের ছাদে হল রান্না। দেড়শোর বেশি কমরেড পার্টি অফিসে। ভোর হতেই সবাই রেডি হয়ে দলবেঁধে জাঙ্গীপাড়া ডিএন হাইস্কুলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে বিডিও অফিস পেরোতেই আশঙ্কা সত্যি হতে শুরু করল। চায়ের দোকান খোলারও আগে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের সশস্ত্র জমায়েত। আমাদের উদ্দেশ্য করে কাঁচা কাঁচা গালিগালাজ। তার সঙ্গে হুমকি, ‘তোদের লাশ ঘর যাবে আজকে বাড়িতে, ঘর জ্বালিয়ে দেব, একটাও সিপিএম জিতবে না জাঙ্গীপাড়ায়’, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্ররোচনায় কান না দিয়ে আমরা পৌঁছলাম গণনাকেন্দ্র ডিএন হাইস্কুলের গেটে।
মমতা ব্যানার্জির সরকারের পুলিশ কতটা হিংস্র, কতটা অমানবিক হতে পারে বুঝলাম স্কুলের গেটে গিয়ে। গরিব মানুষের হাতে আনা সামান্য দশ টাকার জলের বোতল, পার্লে জি বিস্কুটের প্যাকেট ছিনিয়ে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে পুলিশ, আর পাশ দিয়ে কোনও চেকিং ছাড়া মদের বোতল আর বাক্সভরা খাবার নিয়ে ঢুকছে তৃণমূল!
গণনাকেন্দ্রে ঢুকে আমরা হতবাক। আমাদের ১৩৫ জন নির্দিষ্ট কাউন্টিং এজেন্ট আর তৃণমূলের সশস্ত্র কয়েকশো জমায়েত আগে থেকেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রত্যেকটা হলে। আমি প্রথমে ঢুকলাম রাজবলহাট ১’র গণনাকেন্দ্র ১ নম্বর হলে। এই রাজবলহাট ১ জিপির বুথে বুথে চলেছিল তৃণমূলের দেদার ছাপ্পা। হলে ঢুকেই দেখি ভেতরে তৃণমূলের কুড়ি জনের বেশি বসে, আমাদের জন্য একটা চেয়ার অবধি নেই। আমাদের দেখেই তৃণমূলের নেতা বাবলু শীল, মুন্না কোমরে গোঁজা মেশিন দেখিয়ে শুরু করল হুমকি। একের পর এক বাক্স খোলা হচ্ছে, আর লুটের জয়ে তৃণমূলের উল্লাস বাড়ছে।
আটটা কি সোয়া আটটা নাগাদ দেখলাম তুমুল চিৎকার। হল নম্বর ১৪, ১৫ যেখানে ফুরফুরা জিপির গণনা চলছিল, সেখানে ঢুকছে জেলা পরিষদ ২৬’র তৃণমূল প্রার্থী, ফুরফুরার প্রাক্তন প্রধান শামীমের নেতৃত্বে হাতে বন্দুক নিয়ে কয়েকশো তৃণমূলের গুন্ডা। আমাদের চোখের সামনে ওই হল থেকে মারতে মারতে বার করা হচ্ছে সিপিআই(এম) আর আইএসএফ’র এজেন্টদের। হলের মধ্যে রক্ত, ঠুঁটো জগন্নাথের মত দাঁড়িয়ে বিডিও, পুলিশ আর কেন্দ্রীয় বাহিনী। একদিকে যখন গণণা কেন্দ্র থেকে মেরে বার করে দেওয়া হচ্ছে এজেন্টদের, তার পরেই পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠিপেটা করছে সেই আক্রান্ত এজেন্টদের। জাঙ্গীপাড়া পার্টি অফিসে ঢুকে আহত এজেন্টদের আবার মারতে থাকে পুলিশ, মাথা ফেটে যায়, হাত ভেঙে যায় , যাতে কোন ভাবেই এজেন্টরা ফের ঢুকতে না পারে গণনা কেন্দ্রে।
বেলা যত বাড়ছে কাউন্টিং হল পুরো তৃণমূলের দখলে। চোখের সামনে যেখানে সিপিআই(এম) জিতছে, মাথায় মেশিন ঠেকিয়ে সার্টিফিকেট নিচ্ছে তৃণমূল। ফুরফুরা জিপিতে গণনার পর দেখা যায় ২২-৭ ব্যবধানে জিতেছে সিপিআই(এম)-আইএসএফ। বন্দুক দেখিয়ে সেই ফল ২৯-০ করে জান্তব উল্লাস শামীম সহ তৃণমূলের।
তিনটা বাজতে যখন আর থাকা যাচ্ছে না গণনা কেন্দ্রে, গায়ে মদ ঢালছে, সবুজ আবির ছুঁড়ে দিচ্ছে তৃণমূল, আমরা পারলাম না থাকতে। একের পর এক ঘুঁষি লাথি পড়ছে সবার গায়ে। বিডিওকে অসহায় আবেদন, ‘স্যার, আমাদের অন্তত প্রাণে বাঁচতে দিন, আমাদের অন্তত বাইরে যাওয়ার সুযোগ দিন’, বিডিও শুনেই আত্মহারা।
বিডিও যখন আমাদের এজেন্টদের দরজা অবধি এগিয়ে দিচ্ছেন, তখন উল্লাস তৃণমূলের। ‘এই শুয়োরের বাচ্চা, খ..ছেলের দল, আর এদিকে আসলে গুলি চালিয়ে দেব। বাইরে তখন বাজছে ডিজে, খেলা হবে! খেলা হবে!
Comments :0