Culture

জাগরণের সংস্কৃতি সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

রাহুল মজুমদার

‘নন্দিনী: রাজা, এইবার সময় হলো।
রাজা: কিসের সময়?
নন্দিনী: আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।
রাজা: আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি ? তোমাকে যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি।
নন্দিনী: তারপর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।’ —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’র শেষাংশে রাজা ও নন্দিনী-র বাকযুদ্ধ ছিল এটি। মহানগরীর বুকে তিলোত্তমার মৃত্যু ও তৎপরবর্তী সামাজিক আলোড়ন আরও একবার স্মৃতি উসকে এই সংলাপগুলোকেই টেনে আনলো। শুধু একটি নাটকের সংলাপ নয়, বাংলার বুকে জাগরণের সংস্কৃতির অতীত ঐতিহ্যকেও খানিকটা উসকে দিল। দুশো বছর আগেই বাংলার বুকে ‘নবজাগরণ’ বা জাগরণের সংস্কৃতি প্রোথিত হয়েছিল একটা মাইলফলক হিসাবে। সেই জেগে ওঠার সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ চাক্ষুস করছে আজকের বাংলা। 
অনেকেরই দেখা বাণিজ্যিক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘বজরঙ্গী ভাইজান’। সিনেমার শেষ দশ-বারো মিনিটের দৃশ্যায়নে দেখানো হয়েছে সোশাল মিডিয়ার অপরিসীম ক্ষমতার বলে প্রতিবেশী দুই দেশের আম-জনতার মধ্যে উঠে আসা আলোড়ন দু’দেশের মধ্যেকার সীমানা ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু সে তো সিনেমার গল্পের দৃশ্যায়নে। বাস্তবের মাটিতে এমনই একটি আলোড়ন তোলা দৃষ্টান্ত ছিল ১৪ আগস্ট মধ্যরাতের দৃশ্যায়ন। অল্প সময়েই অগণিত মানুষের প্রচেষ্টায় অসংখ্য প্রতিবাদী উঠোন জানান দিল বাংলার মাটির গভীরে আজ আরও একবার প্রবেশ করতে সক্ষম এই জেগে ওঠার সংস্কৃতি। কল্লোলিনীর দীর্ঘ ঐতিহ্যের মাটিতেই এমন জাগরণের সংস্কৃতির বীজ লুকিয়ে আছে। আজ থেকে দুশো বছর আগে উনিশ শতকের নবজাগরণের কালপর্ব সমাজ জীবনের বহু গন্ডিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। যুক্তিবোধ, মননশীলতার প্রসারে অসংখ্য প্রশ্ন উত্থিত হয়েছিল সেই কালপর্বেই।
শুধু ১৪ আগস্ট মধ্যরাত নয়, আরও বহু পথ, আঙিনার দখলের মধ্যে সংক্রমণের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল এই প্রতিবাদের সংস্কৃতি, জাগরণের সংস্কৃতি। পুনর্জাগরণ, পুনরুত্থান যে শব্দেই চিহ্নিত করা হোক না কেন, একটা সময়পর্ব নিজে থেকেই চিহ্নিত হচ্ছে, হতে চলেছে। গুটিকয় বছর আগেই বেনজির কোভিড সংক্রমণ পরিস্থিতি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। জীবাণু সংক্রমণের মোকাবিলায় এই বিচ্ছিন্নতা যদিও শারীরিক। কিন্তু গত দু’-তিন দশক জুড়ে এই ভূখণ্ডে প্রতিটি মানুষকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার যে জীবাণু দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধি করে চলেছে তারও খুব বেশি অতীত নজির মেলে না। আবার এমন বিচ্ছিন্নতার, হতাশার জমিতেই গভীর আত্মবিশ্বাসের বুনন ঘটে বইকি। যখন হাজারো প্রশ্ন, অজস্র প্রতিবাদী চিন্তনকে নিয়ে এক সরণিতে মেশে।
বৈপরীত্য, বিভিন্নতা নিয়েই মানুষের সংস্কৃতি। যুক্তিবাদ, আত্মসম্মানবোধ, প্রতিবাদী মনন, অনুসন্ধিৎসু মনের সংস্কৃতি যেমন রয়েছে; তেমনই প্রশ্নহীন আনুগত্য, সুবিধাবাদ, পরজীবী, পরনির্ভরশীলতার সংস্কৃতিও রয়েছে। কিন্তু জন্মাবধি মানুষ প্রতিবাদী এবং ইতিহাসের রোপণ হয় একমাত্র প্রতিবাদী সংস্কৃতির জঠরেই। এই ভূখণ্ডের সংখ্যাগুরু ধর্মীয় মৌলবাদ বা আরও স্পষ্ট করে বললে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে কর্পোরেট বা বাজার মৌলবাদের বোঝাপড়া প্রায় শিল্পকর্মের পর্যায়ে উন্নীত। উভয়েই আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির জাল বুননে পটু। একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের বিরোধীও বটে। উভয়ের মধ্যেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা শুধু ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাচ্ছে তাই নয়, জীবন-দর্শনেরও বিকৃতি ঘটিয়ে চলেছে দ্রুতলয়ে। যে কোনও ভূখণ্ডেই মাথাচাড়া দেওয়া সংখ্যাগুরু মৌলবাদের তারস্বরে বেজে চলা মাইকে বাস্তবের উলটো পথে হেঁটে সংখ্যালঘুর বংশবৃদ্ধি যতটা না ঘটিয়ে ফেলছে তার চাইতে অনেক বেশি পরিমাণে পরজীবী প্রজন্মের বংশবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, চৌর্যবৃত্তি, সীমাহীন দুর্নীতি— এসবই উত্তরাধুনিক জীবনচর্যায় পরিশীলিত হয়ে গা-সওয়া। কার্যত আমাদের সংগ্রামী চেতনাকে ভোঁতা করাই এই বৌদ্ধিক অত্যাচারের লক্ষ্য। কিন্তু আপাত নজরে কাশ্মীর থেকে কন্যা কুমারী ধর্মের সওদায় কিংবা মিথ্যাচারের ফানুসে যে শাসক ছড়ি ঘোরাচ্ছে তারও বিরোধিতায় বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর জেগে উঠছে বইকি। রাজনৈতিক পরিসর তার সপক্ষে জোরালো নজির খোদাই করতে না পারলেও সামাজিক প্রেক্ষাপট মোড় বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কর্পোরেট ও ধর্ম বেনিয়াদের মেলবন্ধনে সন্দেহ নেই এই বাজার মৌলবাদ অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু তার চাইতেও আরও অনেক শক্তিশালী হলো দ্বন্দ্ব বা ডায়ালেকটিকস। এই দ্বান্দ্বিকতাই বিকল্প পথ প্রসারিত করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যাবতীয় আলোড়ন শুধুমাত্র সামাজিক চিত্রপটেই প্রতিভাত। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতির সঙ্গে সমাজ সংস্কৃতির সম্পর্ক বিপরীতমুখী নয়, পরস্পর পরিপূরকের, প্রভাব বিস্তারের। আরও স্পষ্ট করে বললে রাজনীতি, অর্থনীতি যেমন সমাজ, মানুষের সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তেমনই সামাজিক আলোড়নও যে কোনও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিন্যাস বা অর্থনৈতিক কাঠামো যদি বুনিয়াদ হয়, তবে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি কিংবা সামাজিক বিন্যাস তার উপরিকাঠামো বলেই চিহ্নিত। ঠিক যেভাবে প্রতিমার বাঁশ ও খড়ের কাঠামোর ওপর মাটির প্রলেপ নির্মাণ করে অপরূপ মূর্তি। ঠিক সেভাবেই সমাজ বিকাশের ধারাতেও অর্থনীতির বিন্যাস সমাজ পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করে।
কিন্তু কখনও কখনও উলটোটিও ঘটে বইকি। তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রাশিয়ার বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ছিল কার্যত তৎকালীন আধুনিক বিশ্বের চোখে ক্লেদমগ্ন স্থবির একটি অর্থনীতি। না, রাজনৈতিক পরিকাঠামোও সেইসময় বিপ্লব আনুকূল্যে ছিল না বললেই চলে। অথচ একটা দর্শন মাত্র অভাবনীয় চেহারায় বিশ্বের বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক মানচিত্র গড়ে দিয়েছে। বলাবাহুল্য মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে। আর্থিক ভিতের ওপরেই গড়ে ওঠে বাকি সবকিছুর ইমারত। কিন্তু যে তত্ত্বের ভিত্তিতে এই ব্যাখ্যা সেই মার্কসবাদ যেহেতু দ্বন্দ্বনির্ভর মতবাদ, তাই আর্থিক বুনিয়াদ আর তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ইমারত— এই ব্যাপারটা কোনোভাবেই শুধু একমুখী নয়। অবশ্যই আর্থিক বুনিয়াদই ইমারতকে প্রভাবিত করে— এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর্থিক বুনিয়াদের বদল হলে তবে ইমারতের পরিবর্তন হয়। কিন্তু এরসঙ্গে এও সত্য যে ইমারতও একটা সময়ে এসে আর্থিক বুনিয়াদকে প্রভাবিত করে, এবং এক আর্থিক বুনিয়াদকে উচ্ছেদ করে মানুষ আর-এক রকমের আর্থিক বুনিয়াদ তৈরি করে।
উনিশ শতকের নবজাগরণের কালপর্বেও বিদ্যাসাগর রামমোহন, রাধাকান্ত, কালীপ্রসন্ন, বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা ডিরোজিয়ানরা যাঁদের কথাই খতিয়ে দেখা হোক না কেন, এঁরা প্রায় সকলেই শুধুমাত্র সামাজিক স্তরেই যাবতীয় আলোড়নকে সীমায়িত রেখেছিলেন। ডিরোজিয়ানদের চাইতেও অনেক বেশি সফল ও প্রভাবশালী সমাজ সংস্কারক ছিলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু তিনিও রাজনৈতিক প্রশ্নে উদাসীন ছিলেন। তবু উনিশ শতকের এই জাগরণের সংস্কৃতির আঁচ কি তৎকালীন রাজনৈতিক বিন্যাসকে উত্তপ্ত করেনি? সেই সময়েরই অক্ষয় কুমার দত্তের একটি সরল তত্ত্বকে আজকের আতশকাচে দেখা যেতে পারে। ঠিক যে সময় কুম্ভ মেলায় চূড়ান্ত অব্যবস্থার বলি হয়ে ধর্মভীরু অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। যখন শনি মন্দিরের সামনে ভক্তদের লাইন ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হচ্ছে। যখন ধর্মের সওদাকারীরা ঘোষণা করছেন কর্ম করে যাও, ফলের আশা কোরো না। তার প্রায় দু’শতক আগে অক্ষয় কুমার দত্ত স্পষ্ট লিখছেন, ‘পরিশ্রম = শস্য। পরিশ্রম+প্রার্থনা= শস্য। অতএব, প্রার্থনা=শূন্য।’
এই প্রসঙ্গের অবতারণা একটাই কারণে, যে সামাজিক আলোড়নে উত্তাল এই কালপর্ব তা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক বলে চিহ্নিত করার একটা সমান্তরাল চেষ্টা সর্বত্র। মেনে নেওয়া গেল এই সময়ের ঘটনাক্রম সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পরিসরেই গণ্ডিবদ্ধ। কিন্তু যে সামাজিক আলোড়ন তোলপাড় করেছে তাঁর ব্যাপ্তি বহু মনন-তটকে সিক্ত করে। আপাত নজরে সব ঝড় থেমে যাওয়ার চিত্র জনমানসে। কিন্তু জেগে ওঠা প্রশ্ন থেমে থাকে না। আলোড়িত হয়, প্রসারিত হয় আরও বহু আঙিনাতে। মহানগরীর বুকে একটি মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক আলোড়ন উত্থিত হয়েছে তা শুধু একটা ভয়ের, ত্রাসের আবরণ জনমানস থেকে খসিয়ে ফেলেছে। আর সেই অনুভূতির কথা কবিগুরুর লেখনীতেই প্রতিভাত হয়েছে — ‘‘যত বড়ো হও,/ তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও।/ আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে/  যাব আমি চলে।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment