Doluakhaki School

‘‘বই বাঁচাতে পারিনি, পরীক্ষা দিতে চাই’’

রাজ্য জেলা বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

প্রতীম দে

গত ১৩ নভেম্বরের পর দলুয়াখাকি প্রাইমারি স্কুল বন্ধ। সেখানে পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। গ্রামে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। যে গ্রাম পুলিশ আজ পাহারা দিচ্ছে সেই গ্রামের ছোট বাচ্চাদের ঘটনার দিন সকালে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মাথার ওপর ছাদ নেই। স্কুলে তারা আর যেতে পারে না। স্কুল বন্ধ থাকায় মিড-ডে-মিলও বন্ধ। চিঁড়ে, মুড়ি খেয়ে বাড়ির লোকদের সঙ্গে খোলা আকাশের তলায় দিন কাটাচ্ছে মৌসুমী লস্কর, রাকিম লস্কররা। 
দলুয়াখাকি গ্রামে জ্বালিয়ে দেওয়ায় ৩০ টি পরিবার ঘর ছাড়া। এর মধ্যে ১৯ জন পড়ুয়া তাদের পড়ার বই, খাতা চোখের সামনে দেখেছে পুড়ে যেতে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত এই ছেলে মেয়েদের জন্য কোনো ত্রাণ পাঠানো হয়নি। এসএফআইয়ের একটি প্রতিনিধি দল গিয়ে তাদের কিছু বই, খাতা এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে এসেছে। এই ১৯জনের মধ্যে হাই স্কুলের ছাত্র যেমন আছে তেমন প্রাইমারি স্কুলের ছেলে মেয়েও আছে।
মৌসুমী লস্করের বাবা মজিবর লস্কর। দলুয়াখাকি বামনগাছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী মৌসুমী। ও জানে না সেদিন সকালে কি কারণে বাড়ি পুড়ে গিয়েছে। কেন গ্রাম জুড়ে এখনও পোড়া গন্ধ। ওর বাবার কথায়, ‘সব শেষ হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ঘর কিছু নেই। কোনো খাবার নেই। পার্টি থেকে যা দিয়েছে তাই খেয়ে আছি। স্কুল চলছে না। ওখানে পুলিশ থাকে। মেয়েটা স্কুলে যেতে পারলেও তো দুটো ভাত পেত।’
দলুয়াখাকি গ্রামের পাশেই চালতাবেড়িয়া হাই স্কুল। স্কুলের ল্যাবে ঠিক ভাবে কোনো ক্লাস করতে পারেন না ছাত্ররা। দলুয়াখাকি গ্রামের আশপাশের একমাত্র হাই স্কুল এই একটিই। ল্যাব আছে। কিন্তু সরঞ্জাম নেই।
ওই স্কুলেরই ছাত্রী রাকিবা লস্কর। নবম শ্রেণির ছাত্রী। বই পুড়ে গিয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষা সমানে। সে জানে না কি ভাবে পরীক্ষায় বসবে, কিন্তু ওর মধ্যে একটাই জেদ যে ভাবেই হোক পরীক্ষায় বসবে।
রাকিবার কথায়, ‘সামনেই পরীক্ষা। বই সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সাহায্য যা পেয়েছি তাই দিয়ে চালাচ্ছি।’ 
স্কুলে ঠিক ভাবে ক্লাস হয়?
—হয়। কিন্তু কিছু সমস্যা আছে।
কি সমস্যা?
—ভালো ল্যাব নেই। বিজ্ঞানের ক্লাস করতে অসুবিধা হয়। সাইকেলে করে স্কুলে যাই। কিন্তু সাইকেল রাখার জায়গাটা ভেঙে গিয়েছে।
মিড ডে মিল দেয়?
—হ্যাঁ


রাকিবারা জানে না সরকারের পক্ষ থেকে মিড ডে মিলের একটা মেনু ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই তালিকা ওই স্কুলে মানা হয় না। জয়নগরের এসএফআই নেতৃত্বের কথায়, ডিম হয় মাঝে মধ্যে। সপ্তাহের চারদিন সয়াবিনই দেওয়া হয় ছাত্র ছাত্রীদের থালায়।
আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তার আগে সব স্কুলে চলছে টেস্ট। চালতাবেড়িয়া স্কুলেও শুরু হবে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা। 
আলিমা খাতুন। দলুয়াখাকি গ্রামের বাসিন্দা। মা গৃহসহায়িকার কাজ করেন। বাবা দিন মজুর। দিদি উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করেছে। আলিমা এবার মাধ্যমিক দেবে। পারবে কি ও পরীক্ষায় বসতে?
আলিমা পরীক্ষা দিতে চায়। সোমবার সকালে বাড়ি হারিয়েছে সে। বাবা সিপিআই(এম) কর্মী, তাই সইফুদ্দিন খুনের পর তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা গ্রামের একের পর এক বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আলিমাদের বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আগামী সপ্তাহ থেকে তার টেস্ট পরীক্ষা। অন্যান্য দিনগুলির মতো সোমবারও সকালে উঠে পড়তে বসার জন্য তোড়জোর করছিল সে। হঠাৎ হামলা চালায় তৃণমূল। চোখের সামনে একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগাতে দেখেছে বছর ১৪র মেয়েটি।
তিনি বলেন,‘‘সকালে উঠে বাড়ির কিছু কাজ করে পড়তে বসার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। সেই সময় হঠাৎ করে হামলা হয় গ্রামে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোন মতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। চোখের সমানে দেখেছি বাড়ি পুড়ে যেতে।’’
বলতে বলতে কেঁপে উঠছিল তার কন্ঠ। ‘‘বই বাঁচাতে পারিনি। অ্যাডমিট কার্ড সঙ্গে আছে। আমি চাই পরীক্ষা দিতে।’’
ওর বাড়িতে যখন আগুন লাগানো হয় তখন নিজের লেখা পড়ার বইগুলিকে বাঁচানের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল আলিমা। পারেনি। আলিমার বই খাতা সব পুড়ে ছাই। কোন মতে নিজের অ্যাডমিট কার্ডটি সে বাঁচাতে পেরেছে। 
আলিমা চায় পরীক্ষায় বসতে। সে চায় লেখা পড়া করে বড় হতে। এসএফআই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কমিটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে তার বইপত্রের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। বর্তমানে আলিমা সহ দলুয়াখাকি গ্রামের বহু মহিলা এবং শিশু দক্ষিণ বারাসতে সিপিআই(এম)’র দলীয় কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেই ‘পার্টি অফিসে’ বসেই লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে খোলা আকাশের বাসিন্দা আলিমা খাতুন।
 

Comments :0

Login to leave a comment