EDITORIAL

বাংলা‍‌ নিজের মানুষকে চায় না

সম্পাদকীয় বিভাগ

এক সময় হাওড়া-মাদ্রাজ করমণ্ডল এক্সপ্রেস দক্ষিণের রাজধানী এক্সপ্রেস নামে যাত্রীদের কাছে পরিচিত ছিল। তখন কলকাতা থেকে দক্ষিণ ভারতে যাবার এর চেয়ে কোনও ভালো ট্রেন ছিল না। পরবর্তীকালে গোটা পূর্বভারত, উত্তর-পূর্ব ভারত, এমনকি বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ ভারতে যাওয়া রোগীরা এই ট্রেনটাকে পছন্দ করতেন। তাই কারো কারো কাছে করমণ্ডল হয়ে যায় রোগী এক্সপ্রেস। সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে এরাজ্যে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে মা মাটি মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর ধীরে ধীরে করমণ্ডল এক্সপ্রেস রূপান্তরিত হয়েছে পরিযায়ী এক্সপ্রেসে। এটা যে নিছক কথার কথা নয় তা গোটা দেশ এমনকি দুনিয়ার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে ওডিশার বালেশ্বরের কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর। শুধু করমণ্ডল এক্সপ্রেসই নয় কেরালা, তামিলনাডু, কর্নাটক ও অন্ধ্র প্রদেশগামী যেকোনও ট্রেনকেই এখন পরিযায়ী এক্সপ্রেস বল‍‌তে অসুবিধা নেই। প্রতিদিন এরাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে হাজার হাজার যুবক পাড়ি দেন দক্ষিণ ভারতের উদ্দেশে। এদের ৯০ ভাগই গ্রামের গরিব পরিবারের ছেলে। নিজের রাজ্যে কোনও কাজ না পেয়ে পেটের দায়ে পরিবার-পরিজনকে ছেড়ে তারা বাধ্য হচ্ছে বিদেশ-বিভূঁইয়ে। নিজের রাজ্যে কাজের আশায় বসে থাকলে কর্মহীন থাকতে হবে। অথবা মাঝে মধ্যে কাজ জুটলেও তাতে যা মজুরি মিলবে সেটা দিয়ে আধপেটা খেয়ে বাঁচ‍‌‍‌তে হবে।


করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পর এই বার্তা যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে যে ওই দুই ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রীই এরাজ্যের এবং তাদের বেশিরভাগই ভিনরাজ্যে কর্মরত বা কর্মসন্ধানী তখন মুখ্যমন্ত্রী খেদের সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন এরাজ্যে যথেষ্ট কাজ থাকা সত্ত্বেও কেন যে অন্য রাজ্যে যায়! কেন যায় সেটা মুখ্যমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। এটা ঠিক এরাজ্যে চপ ভাজা, চা বিক্রি, ঘুঘনি বিক্রি, ধূপকাঠি বানানো, কাশ ফুলের বালিশ ইত্যাদি কাজে যুক্ত হওয়া যায়, কিন্তু তাতে সংসার চলবে না। এরাজ্যে অনেক সাধ্য সাধনার পর যে কাজ মেলে তাতে মজুরি মেলে যৎ সামান্য। সেই একই কাজ দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে গিয়ে করলে অনেক বেশি মজুরি মেলে। স্বাভাবিকভাবেই বেশি রোজগারের আশায় এরাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে যাবেন। এরাজ্যের শ্রমিকরা কেরালায় গিয়ে তিনগুণ মজুরি পান। সঙ্গে অনেক সরকারি সুবিধাও মেলে। এরাজ্যে সেসবের কোনও বালাই নেই।


আসলে মজুরির হার বাড়ে তখন রাজ্যের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত হয়। পশ্চিমবঙ্গ এখন তৃণমূল শাসনে শিল্পের মরুভূমি। মমতা সম্ভাবনাময় শিল্প ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তূপে শাসন কায়েম করেছেন। গত এক যুগ ধরে এরাজ্যে শিল্পে কোনও বিনিয়োগ হয়নি। কোনও নতুন কারখানা হয়নি। উলটে বন্ধ হয়েছে শত শত কারখানা। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির যাবতীয় সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। রাজ্যে মেধাবী, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা কাজের জন্য প্রবাসী হচ্ছে কর্নাটক, তামিলনাডু, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, দিল্লি, হরিয়ানা প্রভৃতি রাজ্যে। ইদানীং শিক্ষার হাল যে তলানিতে এসে ঠেকেছে তাতে একটা বড় অংশের ছেলেমেয়েও পড়াশুনার জন্য চলে যাচ্ছে অন্যরাজ্যে। দক্ষ, শিক্ষিত মানুষ বর্জিত বাংলা পা বাড়িয়েছে অদক্ষ-অর্ধদক্ষ বাংলার পথে। সেই বাংলায় মজুরির হার সবচেয়ে কম হবে তাতে আশ্চর্য কি!
 

Comments :0

Login to leave a comment