কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আমেরিকান পডকাস্টার লেক্স ফ্রিডম্যান, যা রবিবার প্রকাশিত হয়েছে। ফ্রিডম্যান এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প, জেলেনেস্কি, নেতানেয়াহু, এলন মাস্ক প্রমুখ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কাজেই এরপর তালিকায় মোদীর নাম আসায় অস্বাভাবিকত্বের কিছুই নেই। দু’বছর আগে ফ্রিডম্যানের দেশ আমেরিকাতে গিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক সাংবাদিকের মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই নাকানিচোবানি খেয়েছিলেন। প্রথমে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেই রাজি ছিলেন না মোদী, তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনের চাপে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে আসতে রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে মাত্র দুটি প্রশ্নের উত্তর দেবেন। তার মধ্যেই মোদীকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকি প্রশ্ন করেছিলেন ভারতে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে। এরপর মোদীভক্তদের পক্ষ থেকে বন্যার মতো ব্যক্তিগত আক্রমণ ছড়ানো হয়েছিল ঐ মহিলা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। সেদিন হোয়াইট হাউস থেকে নিন্দা করতে হয়েছিল সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারী ও আক্রমণকারীদের। ফ্রিডম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বসার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম, এখন যেন বসন্তের হাওয়া বইছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতির নাম এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাই নিশ্চিন্তে মোদী তিন ঘণ্টা ধরে ইন্টারভিউ দিয়েছেন, তবে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার শুনলেই বোঝা যাচ্ছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিকের সঙ্গে ভক্তরূপী সাংবাদিকদের সাংবাদিকতায় তফাত। কিন্তু এতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন মোদী, সুদীর্ঘ পডকাস্টে মোদী নিজের শিশু বয়সের ‘দারিদ্র’ থেকে ’বিশ্বগুরু’ হওয়া পর্যন্ত নানা বিষয়ে নানা কথা বলেছেন। সেইসঙ্গে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আরএসএস’এর, প্রকৃত সেবকের মতোই।
কিন্তু সমস্যা হয়েছে গুজরাট গণহত্যার সাফাই গাওয়া নিয়েই। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী বিষয়টি উত্থাপনের সময় নিজেই বলে দেন, আদালত মোদীকে গুজরাট হিংসায় ‘ক্লিন চিট’ দিয়েছে, হিংসায় মোদীর কোনও ভূমিকা ছিল না। এরপরে একতরফা মোদী ২০০২ সালের গুজরাটের গণহত্যার ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, দেশে এবং দুনিয়ায় ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি যে নাশকতা চালাচ্ছিল তাতে গুজরাটের মানুষ উত্তেজিত ছিলেন এবং তাই ওই ঘটনা ঘটেছিল বলে কার্যত গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে মোদী জানিয়ে দিয়েছেন, ২০০২ সালের পরে গুজরাটে নাকি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গুজরাটের গণহত্যার ঘটনার সময়ে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু এই সাক্ষাৎকার শুনলেই বোঝা যায়, প্রশ্নকর্তা এবং উত্তরদাতা উভয়ে মিলিতভাবে যখন অপরাধ ধামাচাপা দিতে সম্মত থাকেন তখন সেই সাক্ষাৎকার থেকে প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। গুজরাট গণহত্যার পরে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে গিয়ে স্টিং অপারেশন করেছিলেন সাংবাদিক রানা আয়ুব। একের পর এক প্রমাণ জোগাড় করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে সর্বোচ্চ স্তর থেকে পরিকল্পনামাফিক গুজরাটের পুলিশ প্রশাসন গণহত্যা রোধে নীরব থেকেছে, পরোক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছে। দু’বছর আগে বিবিসি প্রকাশিত তথ্যচিত্র গুজরাট ফাইলসেও একইভাবে দেখানো হয়েছিল প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় গুজরাটে সংখ্যালঘুরা গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন, আর মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে সাফল্য পেয়েছিলেন।
মার্কিন রাষ্ট্রপতির নাম পালটে ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ে গেলে কিংবা প্রশ্নকর্তা মার্কিন সাংবাদিকের নাম পালটে লেক্স ফ্রিডম্যান হয়ে গেলেও ইতিহাস এত সহজে পালটানো যায় না। যে আমেরিকা এখন মোদীকে বন্ধু ঠাওরাচ্ছে, সেই মোদীকেই ২০০২ সালের গণহত্যার পরে দীর্ঘদিন আমেরিকা ভিসা দেয়নি। আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল মোদীর। এখন অন্তত প্রোপাগান্ডায় ইতিহাসকে মুছে দেওয়া যাবে না।
Comments :0