Mughal History

ইতিহাস ধ্বংসেরই চেষ্টা হচ্ছে

জাতীয়

mughal age indian history ncert communal politics bengali news জেসুইট পাদ্রীদের সঙ্গে সম্রাট আকবরের সাক্ষাৎ। ছবিঃ সংগৃহীত।

ভারতের ইতিহাসকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইছে বর্তমান শাসক, বললেন প্রবীন ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব। এনসিইআরটি দ্বাদশের বই থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয় বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বুধবার ইরফান হাবিব গণশক্তিকে বলেন, মুঘল শাসন ভালো বা মন্দ হোক, ইতিহাসেরই তো অংশ। মুঘল শাসনকে খারাপ মনে করলেও সেটা আমাদের ইতিহাস, অস্বীকার করার তো উপায় নেই। আসলে ইতিহাসকেই ধ্বংস করতে চাইছে বর্তমান শাসক।

 ইতিহাসবিদ রত্নাবলী চট্টোপাধ্যয় মনে করছেন, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে গড়ার প্রয়াস চলছে। সেটার সঙ্গে মানানসইভাবে ইতিহাস লেখার এবং পড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীরা যা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তার সঙ্গে বিরোধ হয় এমন কোনও ঐতিহাসিক তথ্য যাতে সামনে না থাকে তেমন পাঠক্রম তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ অধ্যাপক অমিত দে এই প্রয়াসকে নিজেদের পছন্দমত করে অতীতকে ব্যাখ্যা করা বলে অভিহিত করেছেন। সরকারের এই পদক্ষেপকে তিনি ভারতের বহুমাত্রিক সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে নিজেদের পছন্দমত একমাত্রিক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। অধ্যাপক দে বলেন, আধুনিকতার সংজ্ঞা হচ্ছে সমন্বয়ী সংস্কৃতি। সেটাকে আঘাত করে নিজেদের পছন্দমত অতীতকে ব্যাখ্যা করলে, সংজ্ঞায়িত করলে, আধুনিকতার দিকে ভারতবর্ষের যে যাত্রা তা ক্ষুণ্ণ হবে। 

উল্লেখ্য, প্রাথমিকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ দেওয়ার কথা জানা যায়। কিন্তু ক্রমশ দেখা যায় ২০০২ গুজরাট দাঙ্গার অধ্যায়, দলিতদের নিয়ে কবিতা, গণতন্ত্র এবং ভারতের বৈচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ের ‘পপুলার মুভমেন্ট’ ইত্যাদি বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে গান্ধীজী, গডসে এবং আরএসএস সম্পর্কিত অংশগুলিও। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উপর প্রভাব, গান্ধীর হিন্দু-মুসলিম একতার অবধারণা সম্পর্কে হিন্দু কট্টরপন্থীদের উসকানি, আরএসএস-কে কিছু সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করার কথাও তুলে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে ইতিমধ্যে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়েছে। 


মোদী সরকারের সূচনা থেকে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে সরব হয়েছেন প্রবীন ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব। তিনি এই বিষয়ে একাধিক বক্তৃতা এবং লেখালেখি করেছেন। তা নিয়ে আক্রমণের মুখেও পড়েছেন হিন্দুত্ববাদীদের। এদিন তিনি বলেন, সংবাদ মাধ্যম থেকে তিনি বিষয়টি দেখেছেন। বইগুলি হাতে পেলে ইতিহাসবিদরা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন। তবে সাধারণভাবে তিনি ওপরের কথাগুলি বলেছেন। 


এদিকে এনসিইআরটি প্রধান দীনেশ সাকলানির দাবি পাঠ্যক্রমকে যুক্তিসঙ্গত বানানোর জন্যে কিছু অংশ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে যা পরিবর্তন করা হয়েছে তা দু’-তিন দিনের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দেওয়া হবে। কোভিড মহামারীর সময়ে স্থির হয়েছিল পাঠ্যসামগ্রীর বোঝা কম করা হবে। সেই মোতাবেক পদক্ষেপ করা হয়েছে।

এই বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিহাসবিদ রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বোঝা কমানোর জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের অংশটিই মনে পড়লো? এইভাবে যুক্তিসঙ্গত ইতিহাস রচনা করা যায়? হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ইতিহাস রচনার প্রসঙ্গের সঙ্গেই তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর করিয়েছেন। তিনি বলেন, মানুষ তার আশপাশে ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ হিসাবে যা দেখছে যেমন তাজমহল, লালকেল্লা ইত্যাদি। সেগুলিকে মানুষ তার নিজের বলে জানে। নিজের দেশের বলে জানে। সেখান থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে তার স্মৃতির উপর একটা প্রলেপ চাপানো, যাতে সে প্রকৃত তথ্যটি ভুলে যায়। 

এই প্রসঙ্গে রাজপুতদের সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্ক তা উল্লেখ করে বলেন, হিন্দুত্ববাদীরা মুঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের সম্পর্ককে শুধু সঙ্ঘাতের সম্পর্ক হিসাবে দেখাতে চায়। ঐতিহাসিকভাবে যা সত্য নয়। তিনি বলেন, শুধু ভারতে নয় গোটা দুনিয়ার ঐতিহাসিকরাই মুঘল সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধশালী যুগ বলে মনে করেন। সেটা বাদ দিয়ে ইতিহাসচর্চা সম্ভব নয়। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, হিন্দু ঐতিহাসিক বলে যাঁদের বলা হয়, তাঁরাও ইতিহাসের যুক্তির বাইরে যাননি। এরা তো ইতিহাসের যুক্তিই মানছেন না। 


অধ্যাপক অমিত দে এনসিইআরটি’র পদক্ষেপকে খুবই চিন্তার বিষয় হিসাবে দেখছেন। তিনি বলেন, মুঘল সাম্রাজ্য একটা নিছক বিষয় নয়। ভারতের মানুষের আত্মপরিচয় অন্বেষণ, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেটা পাঠক্রমে যদি গুরুত্ব না পায়, স্কুলের পাঠক্রম থেকে বাদ যায় তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল হবে। 

টেনিসন একসময়ে বলেছিলেন, ব্রিটিশ শাসন আকবরের শাসনের সঙ্গে তুলনীয়। তারমানে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের যাঁরা বুদ্ধিজীবী তাঁরা পর্যন্ত আকবরের শাসনকে একটা মানদণ্ড হিসাবে দেখেছেন নিজেদের গৌরব প্রকাশের জন্য। রবীন্দ্রনাথ এই কথার প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, টেনিসন সঠিক কথা বলেননি। আকবরের সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশদের থেকে উৎকৃষ্ট ছিল। কারণ, আকবর ভারতবর্ষের মানুষের আত্মার সন্ধান পেয়েছিলেন। যা ব্রিটিশরা পায়নি। তাই দুটো তুলনীয় নয়। 


অমিত দে বলেন, পৃথিবীতে আর কোনও সাম্রাজ্য পাওয়া যায় না, যেখানে সম্রাটের মাতৃভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে কায়েম করা হয়নি। কিন্তু মুঘল শাসকরা তা করেননি। মুঘলদের মাতৃভাষা ছিল চুঘতাই তুর্কি। কিন্তু সেই ভাষাকে সরকারি ভাষা করেনি। আগের থেকে যে ফার্সি ভাষা ছিল, যা হিন্দু, শিখ, মুসলিম সকলেই চর্চা করতো, তাকে সরকারি ভাষা করেছিল। এটা নিছক ধর্মীয় ভাষা ছিল না, সেটার একটা সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল। 

এর থেকে তাদের উদারতা, বহুত্ববাদে বিশ্বাস, সমন্বয়ী সংস্কৃতিতে বিশ্বাস সেটাই প্রতিভাত হয়। মুঘলরা একটা মিশ্র সংস্কৃতি, সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। মুঘলদের কাছে সাম্রাজ্যের সংজ্ঞা বহুত্ববাদের উপর ভিত্তি করেই ছিল। একমাত্রিক ছিল না। তাই মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস পাঠক্রম থেকে বাদ দিলে মৌলবাদীদের হাত শক্ত হয়। শুধু হিন্দু মৌলবাদী নয়, মুসলিম মৌলবাদীরাও খুশি হবে। কারণ, তারাও যে একমাত্রিকীকরণ করতে চায়, সেই ধারাই শক্তিশালী হবে।


 

Comments :0

Login to leave a comment