অনিন্দ্য হাজরা
“আমরা আগের বারেও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছি। কিন্তু সরকারি চাকরি পাইনি। তোমরা তো আমাদের দাবি নিয়েই লড়ছ। তাই আমাদের মনে হয়েছে ইনসাফ যাত্রার পাশে দাঁড়ানো উচিত। নিজেরা হাঁটতে না পারলেও মানসিক ভাবে তোমাদের পাশে আছি।”
বৃহস্পতিবার ছিল ইনসাফ যাত্রার ৪৯ তম দিন। আমতলা থেকে বারুইপুর, দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার পথ হেটেছেন পদযাত্রীরা। পথে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে আসা স্থায়ী পদযাত্রীদের সঙ্গে। সেই টুকরো কথার মাঝেই নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন দীপক সিংহ।
দীপকের বাড়ি হুগলির উত্তরপাড়ায়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে যুব আন্দোলন, সবটাই কলকাতায় করা হয়। চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। মেদিনীপুর থেকে টানা হাঁটছেন পদযাত্রায়।
দীপকের অভিজ্ঞতায়, " হুগলির কোন্নগর থেকে চুঁচুড়ার দিকে তখন হাঁটছিলাম আমরা। রাস্তায় হঠাৎ দেখি কয়েকজন নাম ধরে ডাকছে। অবাক হয়ে দেখলাম, ভিড়ের মাঝে কয়েকটা চেনামুখ। চাকরি প্রার্থী আন্দোলনে আলাপ হয়েছিল।"
মফঃস্বলি শীতের সন্ধ্যার সেই কথপোকথন উল্লেখ প্রতিবেদনের শুরুতেই করা হয়েছে।
যুব নেতৃত্ব বলছেন, কৃষি সঙ্কট, গ্রামীণ দুর্নীতির পাশাপাশি ইনসাফ যাত্রা প্রবল ভাবে সরব নিয়োগ দুর্নীতি নিয়েও। এই দুর্নীতির ভুক্তভোগী মূলত রাজ্যের যুবসমাজ। তাই ইনসাফ যাত্রার খোঁজ পেয়ে নিজেরাই বহু জায়গায় সামিল হচ্ছেন তাঁরা।
দীপকের কথায়, " উচ্চ-প্রাথমিকে এখন ইন্টারভিউ চলছে। কিন্তু ২০১৯ এবং ২০২১ সালেও এর ইন্টারভিউ হয়েছে। তাতে দুর্নীতি হওয়ার ফলে নতুন করে ইন্টারভিউ নিতে হচ্ছে। ২০২২ সালেও টেট হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ কোথায়? এই বছর ২৪ ডিসেম্বর ফের টেট হবে রাজ্যে। সবই হচ্ছে নিয়োগ ছাড়া।"
কলকাতার অভিজিৎ ঘোষ এবং পুরুলিয়ার অভিজিৎ চক্রবর্তীর অভিজ্ঞতা আবার অন্যরকম। হাওড়ায় পদযাত্রা চলাকালীন উলুবেড়িয়ায় সিপিআই(এম) কর্মী-সমর্থক ও দরদীদের বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইনসাফ যাত্রীরা। দুই অভিজিতের কথায়, " আমরা যেই বাড়িতে ছিলাম, সেখানে রাতের খাবারের পরে এক বয়স্ক লোক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। একথা সেকথা বলতে বলতে তিনি বলেন, যে ইনসাফ যাত্রা চলাকালীন তাঁর ছেলেকে একপ্রকার জোর করে মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।"
স্বাভাবিক ভাবে তাঁরা প্রশ্ন করেন, "ছেলেকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন কেন?"
উত্তরে বৃদ্ধ বলেন, "আমার ছেলে কোভিডের সময় রেড ভলান্টিয়ার হয়েছিল। তারজন্য তৃণমূলের নেতারা ওর অস্থায়ী চাকরি কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। কোনওক্রমে হাতে পায়ে ধরে সেটা আটকেছিলাম। কিন্তু ছেলে ২১'র ভোটেও লালঝাণ্ডার জন্য কাজ করল।"
তারপর?
বৃদ্ধের কথায়, "প্রথমে কিছুদিন ঘরছাড়া ছিল। তারপরে এক রকম মুচলেকা দিয়ে বলতে হয়েছিল যে আর বামপন্থীদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখবে না। কিন্তু ইনসাফ যাত্রা পাড়া দিয়ে গেলে কি ও না এসে থাকতে পারত? তাই মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওর কাজটা চলে গেলে আমাদের পথে বসতে হবে।"
যদিও সেই ছেলেকে আটকে রাখা যায়নি। গভীর রাত্রে পাঁচিল টপকে প্রতিবেশীর বাড়িতে ঢুকে ইনসাফ যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে গিয়েছে সে। কথা দিয়েছে, ব্রিগেডের মাঠে ফের একবার সব্বার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
আলিপুরদুয়ারের মৌমিতা দত্তের উপলব্ধি যদিও হৃদয়স্পর্শী। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ৪টি হাসপাতাল ঘুরে, বিনা চিকিৎসায় মারা যান উত্তর ২৪ পরগণার শ্যামনগরের ১৮ বছরের পড়ুয়া শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কোভিড টেস্টের রিপোর্ট না থাকায় শ্বাসকষ্ট নিয়েও হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেনি শুভ্রজিৎ। অবশেষে তার মা আত্মহত্যার হুমকি নিলে মেডিক্যাল কলেজ ভর্তি নেয়। যদিও ততক্ষণে সব শেষ। ২০২১'র সেপ্টেম্বরে শুভ্রজিতের কোভিডের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
মৌমতা বলছিলেন, "শ্যামনগর দিয়ে আসার সময় শুভ্রজিতের মা ইনসাফ যাত্রায় এসেছিলেন। তাঁর বলা, আমি শুভ্রজিতের জন্য ইনসাফ চাই, রাতে ঘুমোতে দেয়না আমাকে। এই যন্ত্রণা বলে বোঝাতে পারব না।"
Comments :0