তথাকথিত ‘গণঅভ্যুত্থানের’ মধ্য দিয়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের উৎখাতের পর উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশের অবস্থা ক্রমাগত ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। মুহাম্মদ ইউনিসকে মাথায় রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তারা প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস রক্ষা করতে তো পারছেই না, বরং দিন দিন উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদের পুতুলে পরিণত হচ্ছে। দেশের আইন শৃঙ্খলায় সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। সর্বত্র যে যেমন খুশি হিংসা-ঘৃণা ছড়িয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধনে প্রাণে বেঁচে থাকা। মৌলবাদীরা সর্বত্র ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। সংখ্যালঘুদের ধর্মস্থান আক্রমণ করছে, ভেঙে চুরমার করছে। ধর্মাচলে ও ধর্মোৎসবে তাণ্ডব চালিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘর ভেঙে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লুটপাট করছে। পুরোপুরি মধ্যযুগের এক বর্বর সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে।
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভকে ভেতর থেকে হাইজ্যাক করে একদিকে বিরোধী দল বিএনপি অন্যদিকে মৌলবাদীরা তাকে তথাকথিত গণঅভ্যুত্থাচেনর চেহারা দিয়ে হাসিনা সরকারকে অপসারণ করে। আমেরিকার পছন্দ মতো ইউনিসের নেতৃত্বে গড়ে দেওয়া হয় অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশের মানুষ যে আশা প্রত্যাশা নিয়ে গণবিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন এবং হাসিনা সরকার অপসারণ করেছিলেন সেই কোনও আশাই নতুন সরকার পূরণ করতে পারেনি। মানুষ চেয়েছিলেন বেকারি দূর করা, অর্থনীতিতে গতি এনে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি, মানুষের রুজি রোজগার বাড়ানো, দুর্নীতি-স্বজনপোষণ বন্ধ ইত্যাদি। এর কোনোটিই হয়নি, বরং যা ছিল তার থেকে অনেক খারাপ হয়েছে। দেশে আইনের শাসন বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। দেশের পরিস্থিতির ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। মৌলবাদীরা উল্লাস-উন্মাদনার শীর্ষে গিয়ে যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে। বস্তুত ধর্মীয় সংখ্যাগুরু মৌলবাদ এখন বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শাসক দল কোণঠাসা হয়ে পড়ায় ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর বিএনপি সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে। অর্থাৎ এক অরাজক অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও ধনসম্পদ বিপন্ন। তাদের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। বিষয়টি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ভারত উদ্বিগ্ন।
আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে পাকিস্তান, আফগানিস্তানে বহুকাল থেকে সেই অবস্থা বিরাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশ চেষ্টা করেছে ধর্মীয় মৌলবাদকে যথাসম্ভব দুর্বল করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে। সেকাজে নিঃসন্দেহে তারা অনেকটা অগ্রসরও হয়েছিল। কিন্তু আবার মৌলবাদী চক্করে পড়ে বাংলাদেশ অন্ধকারে তলিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে।
বাংলাদেশ তো বটেই সমগ্র উপমহাদেশেরই সবচেয়ে বড় বিপদ মৌলবাদ। এই মৌলবাদ ধর্মকে আশ্রয় করে মানুষের যুক্তি ও বিজ্ঞানবোধকে নির্মূল করে দিচ্ছে। মৌলবাদীরাই ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সংশ্রব ঘটিয়ে হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির জন্ম দেয়, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুদের ক্ষেপিয়ে তুলে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি যে কোনও দেশের যেকোনও সমাজের বিকাশের অন্তরায়। এটা মানুষের ঐক্য ও সম্প্রীতি ভেঙে চুরমার করে দেয়। অশান্তির আগুন জ্বালায়। শান্তি ও সুস্থিতি নষ্ট করে। এক ভীতিময় উদ্বেগের সমাজ উপহার দেয়। এই সমাজে মানুষের মেধা, দক্ষতা, প্রতিভা শুকিয়ে যায়। গোটা সমাজ পিছিয়ে পড়ে। এই দুর্দশা থেকে মুক্ত নয় ভারতও। এখানেও মৌলবাদীরা কম সক্রিয় নয়। সংখ্যাগুরু ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি এখানেও সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে। নানাভাবে তাদের উপর হামলা চালায় বিভাজনের রাজনীতির ফসল তুলতে।
Editorial
মৌলবাদ তাড়িত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি
×
Comments :0