GANASHAKTI EDITORIAL FOR 18 FEBRUARY

কর্পোরেট হিন্দুত্বের গ্রাস

সম্পাদকীয় বিভাগ

editorial adani bengali news

খেত মজুরদের সর্বভারতীয় সম্মেলনের এক বি‍‌শেষ অধিবেশনে ভারতীয় সমাজ-সভ্যতার বিকাশের বর্তমান স্তরে এক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ গুণগত পরিবর্তনের দিকে আলোকপাত করেছেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা প্রকাশ কারাত। অপ্রত্যাশিত ও অভাবনীয় এই পরিবর্তনকে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও বিপজ্জনক বলে তিনি চিহ্নিত করেছেন। কি সেই বিপজ্জনক গুণগত পরিবর্তন যা আরএসএস-বিজেপি’র সচেতন প্রয়াসে নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে সংগঠিত হচ্ছে? নিঃসন্দেহে সেটা সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে কর্পোরেট স্বার্থের বোঝাপড়া। 

নরেন্দ্র মোদীর কৃতিত্ব তিনি এই দুইয়ের জোটকে স্বার্থক রূপ দিয়ে ভারতীয় সভ্যতার মূল ভিতটাকেই অনেকটা টলিয়ে দিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক-কৃষক ও সমাজের বঞ্চিত পশ্চাদপদ অংশের স্বার্থকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে কর্পোরেট স্বার্থবাহী তথা বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থবাহী নয়া উদারনীতির প্রয়োগ সহজসাধ্য নয়। তাই সেই ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হলেও নয়া উদারনীতির বেপরোয়া প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। বাজপেয়ীর জমানায় কিছুটা গতি পেলেও মসৃণ হয়নি। ইউপিএ সরকারও নয়া উদারনীতিই প্রয়োগ করেছে তবে পরিস্থিতির চাপে খুল্লামখুল্লা হতে পারেনি। শুরু থেকে প্রায় আড়াই দশক ধরে যা সম্ভব হয়নি তাকে সম্ভব করে তুলছে মোদী সরকার। অর্থনীতির লাগামটা পুরোপুরি কর্পোরেটের হাতে ছেড়ে দিয়ে কর্পোরেটের স্বার্থের সঙ্গে সরকারের স্বার্থকে একাত্ম করে দিয়ে এক নতুন ধরণের ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে দ্রুত এগতে চাইছে নরেন্দ্র মোদীরা।


আরএসএস’র ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীরা বরাবরই কর্পোরেট পুঁজির  স্বার্থের পক্ষে। কর্পোরেট স্বার্থের সঙ্গের আরএসএস’র স্বার্থের কোনও বিরোধ নেই। একে অন্যের পরিপূরক। আগে এমন একটা ধারণা অনেক মানুষ পোষণ করত যে আরএসএস ক‍‌‍‌র্পোরেটের সঙ্গে একাত্ম হতে চাইলেও কর্পোরেট তাতে সায় দেয় না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে  কর্পোরেট পুঁজি তাদের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে বেছে নিয়েছে আরএসএস-বিজেপি’কেই। বিজেপি’র তহবিল ভরানোর দায়িত্ব দিয়েছে ভারতীয় কর্পোরেট। তেমনি বিজে‍‌পি  দায়িত্ব নিয়েছে কর্পোরেটের ভাড়ারে দেশের যাবতীয় সম্পদ জমা করার দায়িত্ব। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি অতীতেও কর্পোরেট অর্থে পুষ্ট হতো। কিন্তু এখন সেই অর্থের প্রবাহ শুধু ঢালাও হয়নি, সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী দলে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। আরএসএস-বিজেপি’র স্বার্থ এবং কর্পোরেট স্বার্থ এখন পুরোপুরি একাকার হয়ে‌ গেছে। কর্পোরেট মনে করে মোদী সরকার তাদেরই সরকার।


কর্পোরেট স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রা‍‌ধিকার পেলে দেশের যাবতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হবে কর্পোরেটের ঘরে। মানুষের উপর শোষণের বহর বাড়ছে। সম্পদ ও আয় বৈষম্য বাড়বে। মানুষের দুর্দশা ও অসহায়তা বাড়বে। বর্তমানে সেটাই হচ্ছে। এই অবস্থায়  শোষণের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধিত ক্ষোভ প্রতিবাদী আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াবে। সেটা আবার সরকার টিকিয়ে রাখার ‍‌ ক্ষেত্রে বিপদ বাড়তে পারে। তাই মানুষের প্রতিবাদের অধিকার, বিরোধিতার অধিকার কেড়ে নিতে সরকারের স্বৈরাচারি রূপ প্রকট হচ্ছে। দমন পীড়ণ বাড়িয়ে, সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে মানুষকে দমিয়ে রাখছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা সম্ভব নয় বলেই সরকারের স্বৈরাচার বাড়ছে। আধিপত্যবাদী মানসিকতা উগ্র হচ্ছে।
দমনপীড়ণ যাতে মানুষ বিদ্রোহী করে তুলতে না পারে তার জন্য ধর্মীয় পরিচিতি সত্ত্বাকে সবার উপরে স্থান দিয়ে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। মানুষকে ধর্মান্ধতায় ডুবিয়ে তাদের যুক্তিবোধকে ভোঁতা করে দিয়ে বিজেপি’র  অনুগামী করে তুলছে। ফলে শোষিত-বঞ্চিত মানুষ ক্ষোভ বি‍‌ক্ষোভ করেও শেষ পর্যন্ত ভোটের সময় ধর্মান্ধতার তাড়নায় হিন্দুত্ববাদে আশ্রয় নেয়। শক্তিমান নেতাকে পরিত্রাতা হিসেবে ভেবে ফেলেন। বিপজ্জনক পরিবর্তন এটাই। এই প্রবণতার ‍‌ মোড় ঘোরাতে শুধু শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই নয়, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই সমানতা‍‌লে চালাতে হবে। সমাজের সব অংশকেই এই লড়াইয়ে শামিল করতে হবে তাদের বাস্তবতার নিরিখে।

Comments :0

Login to leave a comment