GDP

জিডিপি’তে লাফ, ফাঁকা খাবারের থালা

ফিচার পাতা

শুদ্ধসত্ত্ব গুপ্ত

জুলাইয়ের শেষাশেষি নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছেন তৃতীয়বার নির্বাচিত হলে ভারতকে তিন নম্বরে তুলে আনবেন। ভারত নয় নম্বরে ছিল আর মেয়াদে পাঁচ নম্বরে এসেছে।
নরেন্দ্র মোদী জিডিপির কথা বলছিলেন এখনও বলছেন প্রতিদিন নিয়ম করে জিডিপির কথাই বলছে, মানে মোট জাতীয় উৎপাদন জুলাইয়ের শেষে যখন বলছেন তখন দেশ তার থেকে শুনতে চাইছে মণিপুরের কথা বিরোধী নেতারা সংসদে দাবি জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী কে মুখ খুলতে হবে। উনি তিন মাস ধরে চুপ কেন শেষ পর্যন্ত সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জবাব দেওয়ার জন্য লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হয়েছে বিরোধীদের।
মোদী যখন ইডিপিতে পাঁচ নম্বরের ভাষণ দিচ্ছেন দেশ তখন দামের জ্বালাতেও জ্বলছে। আয় বাড়ে না দাম বাড়ে, চালের ডালের আলুর তেলের পেঁয়াজের এমনকি টমেটো খাবে কি? সেই চিন্তাতেই মাথা খারাপ রামচরণ আর রহিমের।
প্রধানমন্ত্রী জবাব দেন না। সংসদে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলতে দেন না, আগের সত্তর বছর নিয়ে কেবল প্রশ্ন তোলেন, প্রশ্ন তুললে সমস্যা এমনকি জিডিপি নিয়েও প্রশ্ন তুললে সমস্যা। 
কেন?


ভারতের মাথাপিছু আয় কত ২০২২ এ মাথাপিছু আয় ২৩৩৮ ডলার এই তথ্য বিশ্বব্যাঙ্কের ভুটানের কত ৩ হাজার ২৬৬ পয়েন্ট ৪ ডলার নেপালের কত ১৩৩৬ ডলার আর বাংলাদেশের কত ভারতের থেকে বেশি ২৬৮৮.৩ ডলার। 
ভারতের মতো এশিয়ার আরেক জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার মাথাপিছু আয় বছরে ৪৭৮৮ ডলার। উত্থানশীল অর্থনীতিগুলির মধ্যে ভারতের সঙ্গে বিবেচিত হয় ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ ভারতের সঙ্গেই বহুপাক্ষিক ব্রিকস গোষ্ঠীর সদস্য ব্রাজিলের মাথাপিছু আয় বছরে ৮৯১৭.৭ ডলার।
যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত ইরাকের মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ৫৯৩৭ দশমিক দুই ডলার আর ধারাবাহিক মার্কিন অবরোধের মুখে থাকা কিউবার মাথাপিছু আয় ৯৪৯৯.৬ ডলার।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের পোষিত প্রতিদ্বন্দ্বী এসব দেশ নয় চীনের সঙ্গে লড়ছে ভারত। চীনের মাথাপিছু আয় কত বিশ্ব ব্যাঙ্কেরই তথ্য জানাচ্ছে ১২ হাজার ৭২০.২ ডলার, ভারতের প্রায় ৬ গুন। 
উমর খালিদ জেলে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনীকে জেলে রাখা হয়েছে দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে। ২০২০’তে পূর্ব দিল্লিতে বেঁধেছিল দাঙ্গা। তার আগে বিজেপি’র নেতা কপিল মিশ্রকে ভিডিও’তে শোনা গিয়েছিল ‘ওদের’ মারার কথা বলতে। মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর দিল্লির ভোটের আগে বলেছিলেন ‘গোলি মারো শালোকো’। তাঁরা সবাই বাইরে।

 
উমর খালিদ কী বলেছেন? 
জুলাইয়ে শুনানি ছিল দিল্লি হাইকোর্টে। পুলিশের হাজির হয়ে বলার কথা। পুলিশ হলফনামা দায়ের করতে পারেনি। আরও একটু সময় লাগবে। বিচারপতি মৃদু ধমক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। 
জেলের বাইরে মনু মানেসরও। তাঁর যদিও ব্যাপার আলাদা। কেননা তিনি গোরক্ষক বাহিনীর প্রধান, নিজেই ঘোষণা করে। রাজস্থান এবং হরিয়ানার সীমান্তে নুহের মতো আরও কয়েক এলাকা নিয়ে মেওয়াত। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ, তাঁরা মিও, ধর্মে মুসলিম। তাঁদের এলাকা মেওয়াতে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মনু মানেসরের গোরক্ষক বাহিনী। মাসখানেক আগে রাজস্থানের ভিওয়ানির দুই যুবককে পুড়িয়ে মেরেছে মনু মানেসরের বাহিনী। 
নুহতে এখন বীভৎস আগুন জ্বলছে। জ্বলছে গুরগাঁও মানে সরকারি নিয়মে গুরুগ্রাম। এসব এলাকা দিল্লি শহর লাগোয়া আর জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের ভেতর। বন্ধ ইন্টারনেট।
বাংলায় রামনবমীতে যেমন হয়েছিল অনেকটা তেমন অস্ত্র হাতে ব্রিজমঙ্গল যাত্রা বিজেপি’র গুরগাঁও জেলা সভাপতি সূচনা করিয়েছিলেন। কেন্দ্রের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী রাও ইন্দরজিত সিং গুরগাঁওয়ের সাংসদ। ভূপিন্দর সিং হুডার ওপর রাগ করে কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন বিজেপি’তে। সেই ইন্দরজিত সিং রাগের মাথায় বলে ফেলেছেন তরোয়াল, বল্লম নিয়ে আর কেউ ধর্মীয় মিছিল করে নাকি। যোগ করেছেন যে দুই সম্প্রদায়েরই হাতে এত অস্ত্র এল কোথা থেকে প্রশাসন জানতে পারল না? 
শোনা যাচ্ছে, ইন্দরজিত সিংয়ের নজরে এসেছে মনু মানেসরের সাঙ্গোপাঙ্গরা। যারা ঘোষণা করেছিল গোরক্ষক থাকবেন মিছিলে। মুসলিমদের তাক করে হুমকিও ছিল। মুসলিম প্রধান নুহতে ঢুকবে মিছিল জানানো হয়েছিল, সেই এলাকায়, যেখানে বিরিয়ানির দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে গোরক্ষাবাহিনীর দাপটে। বহু অংশ হিংসার আশঙ্কা জানিয়েছিলেন মনু মানেসরকে নিয়ে পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার পরপরই। বুঝতে পারছিলেন কী হতে চলেছে।  
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর সত্যিই বুঝতে পারেননি। তিনি বলেছেন ‘বড় ষড়যন্ত্র’ এ কথা বোঝা গিয়েছে। আর মনু মানেসর কোথায় তাঁর সরকার জানতে পারেনি, ধরতে পারার তো কথাই উঠছে না। আর বলেছেন সবাইকে সুরক্ষা দিতে পারে না কোনও সরকার। মমতা ব্যানার্জি সেদিনই বলেছেন যে মনোহরবাবুই ঠিক। সবাইকে সুরক্ষা দিতে না পারার মানে আসলে কাউকে কাউকে বেছে নিয়ে জীবনের, জীবিকার অধিকার কেড়ে নেওয়া। মমতা সম্ভবত সেই মতেরও সমর্থক। বিরুদ্ধে মানেই তার জন্য সরকার-সংবিধান কেউ নেই, দুই সরকারের অভিধান একই রকম!  
সমর্থকরা কী সুরক্ষিত? তাঁদের জীবন-জীবিকার অধিকার কী সুরক্ষিত? কেবল হিন্দু-মুসলিম সমীকরণ নয়। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদকে অবস্থানে বসতে হয়েছে। একাধিক দাবি, তার একটি হলো গবেষক নির্বাচনে বেছে বেছে পিছিয়ে থাকা সামাজিক অংশের নম্বর কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।  


মণিপুরে হিংসা নিয়ে কথা বলবেন না প্রধানমন্ত্রী। নিয়মিত বলছেন তাঁর সময়েই মোট জাতীয় উৎপাদনে ভারত নয় থেকে তিন নম্বরে এসেছে বিশ্বে। ভুল বলেননি। মোট জাতীয় উৎপাদন মানে কোনও এক বছরে কোন দেশে পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনের মূল্য। চলতি দামে হিসেব করলে ভারত রয়েছে পাঁচ নম্বরে। আর ক্রয়ক্ষমতার সমতা সূচকে হিসেব করলে তিন নম্বরে। যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার বা আইএমএফ এই তথ্য দিচ্ছে, সে-ই হাজির করছে আরেকটি তথ্য। 
মাথাপিছু জিডিপি, মানে লোকসংখ্যা দিয়ে মোট জিডিপি’কে ভাগ করে হিসেব করা হলে ভারত বিশ্বের ১৩৯ নম্বরে। পিপিপি দিয়ে হিসেব করলে ১২৭ নম্বরে। 
এই মাথাপিছু আয় বা গড় আয় অনেকসময় ভুল ধারণা দেয়। যেমন দশজনের মধ্যে তিনজনের আয় ১০০ টাকা করে। বাকি সাতজনের আয় ১০ টাকা করে। মাথাপিছু আয় হবে ৩০০+৭০= ৩৭০ ভাগ ১০, মানে ৩৭টাকা। সত্যিই তো আর সবাই ৩৭ টাকা পায় না। কারণ আয়ের বৈষম্য।
প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি যে কথাটা চেপে যাচ্ছে তা’হলো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য যে যে দেশে, তার একটা ভারত। খাদ্যে বৈষম্য, পুষ্টিতে বৈষম্য, আয়ে বৈষম্য, চাকরিতে বৈষম্য, জীবনমানে বৈষম্যের দেশ ভারত। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোয়ালিটি ডেটা’ জানাচ্ছে ১৯৫১’তে, স্বাধীনতার ঠিক পরপর, ওপরতলার ১০ শতাংশের হাতে ছিল ৩৭ শতাংশ আয়। নিচেরতলার ৫০ শতাংশের হাতে ছিল আয়ের ১৮ শতাংশ। ১৯৮২ নাগাদ এই ছবি খানিকটা বদলায়। ওপরতলার ১০ শতাংশের হাতে থাকে ৩০ শতাংশ আর নিচেরতলার ৫০ শতাংশের হাতে ২১ শতাংশ আয়। উদারবাদী অর্থনীতি চালু হলো ১৯৯১ থেকে। ২০০০ সালে দেখা গেল ওপরতলার ১০ শতাংশের হাতে আয় ৪০ শতাংশ, নিচেরতলার ৫০ শতাংশের হাতে  ১৮.৫ শতাংশ। ২০১৮’তে ওপরতলার ১০ শতাংশের হাতে ৫৭ শতাংশ নিচের অর্ধেক অংশের হাতে আয় ১৩ শতাংশ। 
২০১১ থেকে ২০২০, গোটা দশকে ওপর তলার ১ শতাংশের হাতে সম্পদের ৩১.৫৫ শতাংশ, ওপরতলার ১০ শতাংশের হাতে ৬৩.৬৮ শতাংশ আর নিচেরতলার ৫০ শতাংশের হাতে ৬.১২ শতাংশ সম্পদ। 


তার মানে যিনি মোদীর হয়ে ভোট দেন তিনি যদি ওপরতলার ১০ শতাংশ না হয়ে থাকেন, তিনি ধর্মের বিচারে হিন্দু হলেও সমানে হারিয়েছেন আয়ের সুযোগ। যেটুকু আয় করেছেন তার চেয়ে বেশি গচ্চা দিয়েছেন কারণ জিনিসের দাম সমানে বেড়েছে। সম্পদহীন হয়েছেন তিনি। নেমে গিয়েছেন অতলে। তথ্য বলছে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ১২১ দেশের মধ্যে ১০৭ নম্বরে। ২০২১ থেকে ২০২২-এ নেমেছে ছয় ধাপ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএমআইই জানাচ্ছে জুলাইয়ে কর্মহীনতার হার ৭.৯৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮’তে এনএসএসও জানিয়েছিল বেকারির হার ৬.১ শতাংশ, ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। এখন সেই হার আরও বেশি।
জিডিপি কাদের সুবিধা দিল? 
গত পাঁচ বছরে কেবল কয়েকজন ব্যবসায়ীর ঋণে ছাড় দেওয়া হয়েছে ১০ লক্ষ কোটি টাকার। সুবিধা পেলেন তাঁরা। সুবিধা পাচ্ছেনও তাঁরা। বাকিদের জন্য পড়ে রইল রামমন্দির আর হিংসা। 
বিরোধী শূন্য করার রাজনীতি ধাক্কা খেয়েছে। বরং একজোট হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দল, ভিন্নমতে সরব বিভিন্ন আন্দোলনও। কৃষক আন্দোলনের সময় তা দেখা গিয়েছে। ‘জিডিপি’তে পঞ্চম’ বলে খাবার জোটাতে নাজেহাল জনতাকে দাবিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
 

Comments :0

Login to leave a comment