যথারীতি জুন মাসেও মূল্যবৃদ্ধির হার চড়াই থেকে গেছে। সরকারে তরফে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ পদক্ষেপের গল্প শোনানো হলেও বাস্তবে সেগুলি যে নিছকই কথা, কাজের কথা নয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সরকার প্রকাশিত পরিসংখ্যানই। জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর জুন মাসের জন্য ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে মূল্যবৃদ্ধির হার উচ্চই নয় গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সরকারি উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেখানে মূল্যবৃদ্ধি হার কমার কথা সেখানে ভোট পর্বে কয়েক মাস তুলনামূলকভাবে সামান্য কম থাকার পর তৈরি ঊর্ধ্বমুখী। তাহলে কি ধরে নিতে হবে ভোটের কথা মাথায় রেখে দরদাম বৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে রাখার সচেতন প্রয়াস ছিল। এখন ভোট শেষ, মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ফের ক্ষমতায়। অতএব মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের আপাতত সরকারের কোনও দায় নেই। তাই ফের চড়তে শুরু করেছে জিনিসপত্রের দাম। বাড়তে শুরু করেছে দৈনন্দিন যন্ত্রণা।
তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্যবৃদ্ধির এই ঘটনায় মুখ্য ভূমিকায় খাদ্য ও আনুষঙ্গিক পণ্য। তারমধ্যে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে শাকসবজির দাম। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ তাদের আয়ের সিংহভাগই খরচ করেন খাবারের পেছনে। সেই খাবারের দাম যদি প্রতিনিয়ত উচ্চহারে বাড়তেই থাকে তাহলে সাধারণ মানুষের পক্ষে অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে খরচ করার জন্য অবশিষ্ট বিশেষ থাকে না। তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যয় ছাঁটাই করতে হয়। সঞ্চয়ের বদলে ঋণের জন্য হাত বাড়াতে হয়। মোদী জমানায় সাধারণ মানুষের জীবনে এটাই নির্মম বাস্তবতা।
কোনও সরকার যদি সত্যিই জনমুখী হয়, সাধারণ মানুষের সমস্যা নিরসনে সচেতন হয় তাহলে মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে তাদের এমন পদক্ষেপ নিতে হয় যাতে সাধারণ মানুষ তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুবিধা হয়। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা যদি সরকার করে তবেই বেশিরভাগ মানুষের উপকার হয়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকার মোটেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। পরিকল্পিতভাবে এমন কোনও নীতি নিচ্ছে না বা হস্তক্ষেপ করছে না যাতে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমার মাঝামাঝি থাকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সীমারেখা নিচে ২ শতাংশ আর উপরে ৬ শতাংশ। মোটামুটি ৪ শতাংশের মধ্যে থাকলে ধরে নেওয়া হয় মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু সরকারের কর্পোরেট মুখীর নীতির জেরে মূল্যবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে দেখা যায় না। তার চেয়েও বড় কথা মূল্যবৃদ্ধির হারে কোনও স্থিরতা নেই। সব সময়ই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ওঠানামা করছে। কখনও ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে আবার নামছে ৫ শতাংশেও। সরকারের যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নেই এই অস্থিরতা তারই প্রমাণ। কোনও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করলে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আবার দাম করে গেলে অবাধ রপ্তানির ব্যবস্থা হয়। কখনও পণ্য মজুতের সীমা সমানো হয়। কখনও বাড়ানো হয়। অর্থাৎ বাজারের উপর, উৎপাদনের উপর, আমদানি-রপ্তানির ওপর সরকারের নির্দিষ্ট কোনও নীতি বা অবস্থান নেই। যখন যেমন তখন তেমন নীতি নিয়ে চলছে। আসলে কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের নারাজ। মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে দিয়ে তাদের বাড়তি মুনাফার সুযোগ দেয়। তারপর হইচই শুরু হলে কিছু সামাজিক পদক্ষেপ নেয়। তারপর আবার যেই কি সেই। সরকার যখন কর্পোরেট বান্ধব হয় তখন সেই সরকারের পক্ষে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। মোদী সরকার কখনই সাধারণ মানুষের স্বার্থে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনবে না বা আনার চেষ্টাও করবে না।
Comments :0