Hace to defeat bjp and tmc

হারাতেই হবে তৃণমূল-বিজেপি-কে

রাজ্য

ধ্রুবজ্যোতি সাহা

একটু জাঁকিয়ে চাদরটা নিয়ে বসেছি। রাত প্রায় ১টা হবে। নিচ থেকে স্লোগানের শব্দ। প্রত্যেকদিনের অভ্যাসে আর হকচকিয়ে উঠিনি কেউই। তার আগে, টানা ৪০দিন চলার পথে কতই না নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। কিভাবে রাতের বুক চিরে নেতাইয়ের রাস্তা দিয়ে একজন কমরেড আরেকজন কমরেডকে আগলে পথ পার করে, কিভাবে রাস্তার দু’ পাশের মানুষ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে থাকেন। গান, স্লোগান, শহীদের মায়ের চোখের জল মুছে ‘তোমাদের মধ্যেই আমার সন্তানকে দেখতে পাই’— এমন অভিজ্ঞতার মধ্যেই লড়াইয়ের ময়দানে মনোবল আরও শক্ত হয়। 
কোচবিহার থেকে প্রায় ১৫লক্ষ মানুষের সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়েছি আমরা। মাটি পালটেছে, আবহাওয়া পালটেছে, জেলার কিংবা জায়গার নাম পালটেছে। কিন্তু কোচবিহারের মালতি বর্মণ আর শ্রীরামপুরের মুস্তারি খাতুনের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো এক, বঞ্চনাগুলিও এক। শিক্ষিত বেকারদের সঙ্গে বঞ্চনার কাহিনী সর্বত্র এক। 
গত ৩ রা নভেম্বর থেকে যত দিন গেছে, ততই শক্তিশালী হয়েছে এই যাত্রা— আমাদের ইনসাফ যাত্রা। যে মিডিয়াগুলি রাজ্যের সবচেয়ে বড় তোলাবাজের, দেশের সবচেয়ে বড় দাঙ্গাবাজের, পাঁচ তাঁরা হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে গরিব বাড়িতে খাবার খেলে পাড়া মাথায় তুলতো, তাঁরা খুব যত্নেই এই ইনসাফ যাত্রাকে ব্ল্যাকআউট করেছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন অংশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, গলি পথ থেকে রাজপথ ছাপিয়ে গগনভেদী স্লোগানে আর মুঠোফোনে নিজের গ্যাঁটের ইন্টারনেট থেকে রাজ্য তথা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। যে কারণেই অনেকেই নিজের মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে সেলফি তুলতে এগিয়ে আসছেন। যাঁদের বড় অংশ তরুণ।
মিছিল যত এগিয়েছে রাস্তা দুই ধরে মানুষের ভালোবাসা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। অধীর আগ্রহে মানুষ অপেক্ষা করছেন কখন ইনসাফ যাত্রা আসবে? বিকেল পাঁচটায় যে মিছিল ঢোকার কথা, সেই মিছিল ঢুকছে রাত্রি নটায়। তবুও মানুষ অধীর অপেক্ষায়। সভা শেষ করার পরেও রাত্রি ১১টায় সমাবেশের স্থান ছাড়ছেন না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যন্ত্রণা ক্ষোভ বিক্ষোভ না থাকলে এগুলি হয় না। 


রাস্তায় মিছিল থামিয়ে মহিলারা এসে বলছেন মিড ডে মিল রান্না করে সামান্য কয়টা টাকা পান, তাতে সংসার কী করে চলে? পার্শ্ব শিক্ষকেরা এসে বলেছেন ১০- ১৫ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলে না। আলিপুরদুয়ার চা বলয়ে চা শ্রমিকদের বিপন্নতার মুখোমুখি হয়েছে ইনসাফ যাত্রা। বন্ধ চা বাগান। রেশন নেই, মজুরি নেই। বানারহাট চা বাগানে এসে মুখোমুখি হয়েছি মজুরিহীন অসহায় বৃদ্ধার। মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়া হাসপাতালে চুক্তি ভিত্তিক কর্মচারীরা বলেছেন মাসে এক হাজার টাকা বেতন। প্রায় ২৪ ঘন্টা কাজ। তারপরেও অনেকের ১৪ মাস বেতন হয়নি। সিভিক ভলেন্টিয়াররা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছেন না—কী ভাবে অফিসার তাঁদের দিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘুষ নেয়। অতিরিক্ত শ্রম, কিন্তু চাকরি, কাজের নিরাপত্তা নেই। শারদ উৎসবের পরেই কোচবিহারের গ্রামের ৩৫% যুবক, কর্মক্ষম মানুষ চলে যান ইট ভাটায়। কৃষকদের মুখোমুখি হয়ে জানতে পেরেছি কোচবিহার জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল ধান, পাট, তামাক চাষে লাভের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি। সরকারি সাহায্য, কৃষি বিমা শুধু সরকারি প্রচারে। কেন্দ্র রাজ্য কোনো সরকারই কৃষকের পাশে নেই। কৃষকরা নিজেদের যন্ত্রণা, অসহায়তার কথা তুলে ধরেছেন ইনসাফ যাত্রার কাছে। উত্তর দিনাজপুরে এসে দেখেছে পুরুষ শূন্য গ্রাম। গ্রামের পুরুষেরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে কাজের তাগিদে। সরকারি সাহায্য নেই, উদ্যোগ নেই, শিল্প নেই। পরিবারের অন্য সদস্যরা আকুলতা নিয়ে আমাদের কাছে জানিয়েছে ইনসাফ যাত্রা যেন তাদের জন্য লড়াই আন্দোলন জারি রাখে। দক্ষিণ দিনাজপুরেও একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে ইনসাফ যাত্রাকে। চাষে লাভ নেই। নতুন শিল্প নেই। সরকারি নিয়োগ নেই। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে যেতে হয়েছে। মালদহে পরিযায়ী শ্রমিকের সমস্যা আছে। তেমনই বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যা, নদী ভাঙন আছে। মুর্শিদাবাদ জেলায় শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া জেলায় পরিযায়ী শ্রমিক, বিড়ি শিল্পে শ্রমিক শোষণ বারে বারে ইনসাফ যাত্রার কাছে ইনসাফ চেয়েছে। ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরির দাবিতে যেমন দিনমজুররা পা মিলিয়েছেন, পা মিলিয়েছেন কয়লা খাদানে শ্রমিকেরা, স্পঞ্জ আইরন কারখানা শ্রমিকেরাও। 
আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, এক চৌমাথার মাঝে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রশ্ন—আপনি ডান দিকে যাবেন, নাকি বাম দিকে? ভয়ে পিছিয়ে আসবেন? নাকি ভয়কে জয় করবেন? এগিয়ে যাবেন? আপনাকেই ঠিক করতে হবে। আমরা এটা মনে করি না যে, শুধু আমরাই এই ব্রিগেড সমাবেশকে সফল করতে পারব। আমাদের দাবির সঙ্গে উঠে এসেছে কারখানার শ্রমিকের কথা, পরিযায়ী শ্রমিকের কথা, কম মজুরি পাওয়া খেতমজুরের কথা, ফসলের দাম না পাওয়া কৃষকের কথা, নারী নিরাপত্তার কথা, কলেজ ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র, শিক্ষার মান উন্নয়নের কথা, সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডি এ-এর কথা। তাই এই পদযাত্রা সফল করার দায়িত্বও সমান ভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছেন সমাজের সব অংশের মানুষ ও সংগঠনগুলি। শহীদের স্ত্রী আমাদের হাতে দিয়েছিলেন রঙ্গন ফুল। পূর্ব বর্ধমানের কথা। শহীদ কমরেড প্রদীপ তা’র অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব আমাদের কাঁধে। সেই দায়িত্বের অংশই ৫০দিনের পদযাত্রা। শহীদের রক্ত রাঙা পথে আমরা যখন একের পর এক জেলা পেরিয়ে এসেছি, তখন সেই জেলার নাম কখনো শহীদ মনসুর আলি, কখনো রিন্টু শেখ, কখনো রমজান আলি বা শহীদ শালকু সোরেন, স্বপন কোলে, মইদুল মিদ্যার জেলায় পরিণত হয়েছে। আরও শহীদ পরিবার ইনসাফ চেয়ে পা মিলিয়েছেন পদযাত্রায়। যুবদের পাশাপাশি ছাত্র, শ্রমিক, মহিলা কৃষক সবারই মিলিত প্রবাহের অভিমুখ হচ্ছে আগামী ৭ই জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশ। আসুন আমরা সকলে আগামী ৭ই জানুয়ারি মিলিত হই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ‘শপথের সমাবেশে।’ 
শপথ কিসের? যে বিশ্বাসে আমরা আরও দৃঢ় হতে পেরেছি গত ৫০ দিনের পদযাত্রায় — তৃণমূলের শাসন থামাতে হবে। বিজেপি-কে রুখতেই হবে। আর কোনও পথ নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment