জলের ট্যাঙ্কই জীবন বাঁচিয়েছে নলিনাক্ষর। আগুনের গোলা আরেকটু হলেই প্রাণ কেড়ে নিত তাঁর। বিন্দুমাত্র সময় খরচ না করে নলিনাক্ষ জলের ট্যাঙ্কে ঝাঁপ দেন। কোমর ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু প্রাণে বেঁচেছেন। কেরালার কাসারগড়ের বাসিন্দা এই ব্যক্তিও পেটের তাগিদেই কুয়েতে যান।
মাঙ্গাফের বহুতলে বুধবারের বিধ্বংসী আগুনে যে ৪৫ জন ভারতীয়ের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ২৪ জনই কেরালার। এই আগুন সবমিলিয়ে ৪৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাণ কেড়েছে। তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন নলিনাক্ষও। আটকে পড়েছিলেন তিন তলায়। নলিনাক্ষের বেঁচে যাওয়া সামান্য স্বস্তি দিলেও কেরালার পাথানমথিত্তা, কোল্লাম, কোট্টায়াম, মালাপ্পুরম, কান্নুর, কাসারগড় সহ বিভিন্ন জেলাতেই শোকের পরিবেশ, ভিনদেশে কাজে যাওয়া ঘরের ছেলের আর না ফেরার যন্ত্রণা নিয়েই রাত কাটিয়েছেন পরিজনরা। আগুনে এমনভাবেই পুড়ে গিয়েছেন তাঁরা, দেহ শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কুয়েত প্রশাসন সেই প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
অন্যদিকে, ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান মাঙ্গাফে পৌঁছে গিয়েছে দেহ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। পাশাপাশি, কুয়েতে নিযুক্ত ভারতীয় দূতাবাসের তরফে মাঙ্গাফ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষার সমস্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কেরালার সাত জন এই অগ্নিকাণ্ডে গুরুতর আহত হয়েছেন। আদান, জাবের, ফরওয়ানিয়া, মুবারক-আল-কাবির এবং জাহরা— এই পাঁচ সরকারি হাসপাতালে হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তাঁদের। জখম অন্যান্যদের চোট গুরুতর না হওয়ায়, সামান্য চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিল, এই দুর্ঘটনায় কেরালার ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ১৯ এবং এখন ২৪। তবে নিহতদের কারোরই নাম-পরিচয় এদিন রাত পর্যন্ত জানানো হয়নি। কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রকের নির্দেশিকার পরই তা প্রকাশ করা হবে।
যে পরিযায়ী শ্রমিকরা কুয়েতে প্রাণ হারালেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ২৩ বছরের স্টিফেন আব্রাহাম সাবুও। পাম্পাদিতে বাড়ি তাঁর। ভাড়ায় থেকেছেন ১৩ বছর। ছ’বছর হলো কুয়েতে কাজ করছেন। পাম্পাদিতে নিজের বাড়িও বানাচ্ছেন। ছ’মাস আগে দেশে ফিরে বাড়ি তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়ে গিয়েছেন স্টিফেন। দু’দিন আগে মা’কে ফোন করে বাড়ির কাজ কতদূর তা নিয়ে অনেকক্ষণ কথাও বলেছেন। নিজের বাড়িতে থাকবেন, তাই জন্য খুব খুশি ছিলেন স্টিফেন।
সেই বাড়িতেই ফিরবেন স্টিফেন, কিন্তু নিথর হয়ে। স্টিফেনের বিয়ের কথাও চলছিল। মেয়ে দেখাও হয়ে গিয়েছে। পরিবার বলতে মা, দুই ছোট ভাই। বাবা প্রদীপও কুয়েতেই কাজ করেন। শোকস্তব্ধ বাবা এখন ছেলের দেহ দেশে ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কুয়েতের মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশই ভারতীয়, বিশেষত কেরালার। একেকটি পরিবারের একাধিক সদস্য কাজ করেন সেখানে। বহু পরিবারই নিজেদের প্রিয়জনের কোনও খবর পাননি এই দুর্ঘটনার পর। কোল্লামের পুনালুরের এক ব্যক্তিও ছিলেন মাঙ্গাফে। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কারোর ফোন বেজে যাচ্ছে, কিন্তু উত্তর মিলছে না। ফলে কেরালার বহু পরিবারই দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
কেন্দ্রের তরফে আশ্বাস ছাড়া আর কোনও সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে কেরালার এলডিএফ সরকার নিহতদের পরিবারপিছু ৫ লক্ষ অর্থ সাহায্যের ঘোষণা করেছেন। জখমদের চিকিৎসার জন্য এক লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে।
দক্ষিণ ভারতেরই আরেক রাজ্য তামিলনাডুর পাঁচ শ্রমিকেরও এই অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে বলে এদিন রাত পর্যন্ত চেন্নাই থেকে পাওয়া খবরে জানা গিয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রী জিঙ্গি কেএস মস্থান জানান, থাঞ্জাভুর, রামানাথপুরম এবং পেরাবুরানি অঞ্চলের বাসিন্দা রামা কারুপ্পান, বীরাস্বামী মারিয়াপ্পান, চিন্নাদুরাই কৃষ্ণমূর্তি, মহম্মদ শেরিফ এবং রিচার্ড নামের পাঁচ শ্রমিক মাঙ্গাফের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের নির্দেশে তাঁদের দেহ রাজ্যে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে, কুয়েত প্রশাসন নিহত ৪৯ জনের মধ্যে ৪৮ জনের দেহ চিহ্নিত করতে পেরেছে। তাঁদের মধ্যে ৪৫ জন ভারতীয় এবং তিন জন ফিলিপাইন্সের নাগরিক। সাত তলা ওই বহুতলে ১৯৬ জন পরিযায়ী শ্রমিক থাকতেন। ওইদিন ভোররাতে আগুন লাগে। রান্নাঘর থেকেই আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তখন প্রায় প্রত্যেকেই ঘুমোচ্ছিলেন। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে কীভাবে বাঁচবেন, ঘুমচোখে তা বুঝতে না পেরেই প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। দমবন্ধ হয়ে প্রাণ হারান বেশ কয়েকজন। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়।
এরকম বিভিন্ন আবাসনেই বহু পরিযায়ী থাকেন। ফলে সেইসমস্ত বহুতলের মালিকদের সতর্ক করা হয়েছে। কোনওরকম গাফিলতির অভিযোগ সামনে আসলেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাঙ্গাফের এই বহুতলেও কোনও বেনিয়ম ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন কুয়েতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আদর্শ স্বারিকা। ভারতীয় নাগরিকদের সুরক্ষায়, জখমদের চিকিৎসার জন্য যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে দূতাবাসের তরফে।
চালু করা হয়েছে একটি হেল্পলাইন নম্বরও (+৯৬৫-৬৫৫০৫২৪৬)। হোয়াটসঅ্যাপেও এই নম্বরে যোগাযোগ করা যাবে। তবে এদিন রাত পর্যন্তও আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। বেশ কয়েকটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বহুতলের একতলায় রান্নাঘরে সিলিন্ডার লিক হয়ে যাওয়াই কারণ।
Comments :0