Labour

বিপর্যয়ে বিপন্নতায় জীবনেরই জয়গান

জাতীয় ফিচার পাতা

অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়

মেঘালয়ের হতাশাকে এবার কিছুটা কাটানো গেল। 
২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বরের দিনটা এখন অনেকটা ফিকে। পাঁচ বছর পার হলো। মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে কয়লা খনন করতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল ১০ শ্রমিকের। পাহাড়ের ওপর ‘র্যা ট হোল মাইনিং’ করতে গিয়ে ওই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। ১৫ জনের খাদান শ্রমিকের দল গর্ত খুঁড়ে কয়লা বার করার সময় খনির আস্তারণ ফুটো হয়ে ঢুকে পড়ে লিটেইন নদীর জল। ৫ জন পালাতে পারলেও বাকিরা আটকে যান।  
অবৈধ খনন হলেও উদ্ধারে কসুর করেনি কেউ। আধুনিক যন্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনী লাগাতার চেষ্টা চালালেও কাজের কাজ হয়নি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত দেহ উদ্ধারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ২ মার্চ সেনাবাহিনী ওই উদ্ধার পর্ব আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করা হয়। দেহ মেলেনি আটকে পড়া শ্রমিকদের। আর সেই ঘটনার আক্ষেপ এখনো বহন করে চলেছেন ‘র্যা ট হোল মাইনার’রা।


২০১৪ সাল দেশের শীর্ষ আদালত ‘র্যা ট হোল মাইনিং’ বেআইনি করার পরে ওই দুর্ঘটনা। সরকারি পর্যায়ে এই ধরনের ‘ইঁদুর গর্ত খনন’ করে কয়লা তোলা হয় না। অথচ এই পথেই উত্তর কাশীতে সাফল্য এসেছে। দীপাবলি দিনে আলো হারানো ৪১ জন শ্রমিককে ফের আলোর মুখে দেখেছেন।
উত্তরকাশী থেকে যমুনোত্রী ধাম যাওয়ার ২৬ কিমি দূরত্ব কমাতে তৈরি হচ্ছিল ওই সাড়ে চার কিমি সুড়ঙ্গ। বিজ্ঞানীরা অনেকেই সেখানে এই ধরনের কাজের বিরোধিতা করেছেন। কানে তোলেনি মোদী সরকার। সেই কাজ করতে গিয়ে ঘটলো বিপর্যয়। বিদেশি যন্ত্র, বিশেষজ্ঞরা যখন বারেবারে হতাশ করেছে, তখন দিল্লি থেকে উড়িয়ে আনা র্যা ট হোল মাইনাররা কামাল করে দিয়েছেন।
টিম লিডার ওয়াকিল হাসানের নেতৃত্বে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে একটানা ২৪ ঘণ্টা কাজের সংকল্পে আড়াই ফুট স্টিলের পাইপের মধ্যে নেমেছেন তাঁরা। দুইজন লাগাতার শাবল-গাঁইতা দিয়ে কেটে গেছেন ধস। পাইপের পিছনে থাকা চার জন হাত দিয়ে সরিয়ে গেছেন সেই আবর্জনা। 
মুন্না কুরেশি নামে একজন মাইনার প্রথম আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে প্রথম পৌঁছালেও, দলবদ্ধ কাজের আকাশছোঁয়া সেই সাফল্যের ভাগীদার গোটা দল। উদ্ধারের পর দেশের নিজের শ্রেণির প্রতি মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে ১৯ বছরের মুন্নার প্রতিটি কথায়। তিনি বলেছেন,‘‘আমি যে আনন্দ পেয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি আমার সাথি শ্রমিক ভাইদের জন্য এই কাজ করেছি। তাঁরা যা সম্মান আমাদের দিয়েছে, তা সারাজীবন আমি ভুলতে পারবো না।’’ 
উত্তরকাশীর সিলকিয়ারা-বালাকোট সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ জন সহযাত্রীকে উদ্ধার করার পরেও ওয়াকিল হাসানের ওই দল কোনও পারিশ্রমিক নেননি। দিল্লির একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে পয়ঃপ্রণালী কাজ করতো ওই দল। সিলকিয়ারায় সুড়ঙ্গ তৈরির কোম্পানি ‘নবযুগ’ ডেকে পাঠিয়েছিল।
কয়লা মন্ত্রকের সব দেশি-বিদেশি যন্ত্র যখন হার মেনেছে, তখন জয় আনলো শ্রমজীবীর মানুষের কায়িক শ্রম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে যন্ত্র যেখানে হার মেনেছে সাফল্য এনেছে এখনকার ‘জন হেনরি’রা। এক বেলায় সমগ্র দেশবাসীর ১৭ দিনের ৪০০ ঘণ্টার উৎকন্ঠার অবসান করে দিলেন তাঁরা।  


এমন জয় মনে করিয়ে দেয় ২০১৮ সালের জুন মাসে থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়ে খুদে ফুটবলারদের কথা। কোচের সঙ্গে বন্যার জলে ভেসে গুহায় আটকে পড়া ১২ জন খুদে ফুটবলারকে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে উদ্ধার করেছিল থাইল্যান্ডের খাদান শ্রমিকরা। বারেবারে জলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একজন, একজন করে সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে।
সুড়ঙ্গ কিংবা গুহা শুধু নয়, প্রতিকূলতার মধ্যে শ্রমজীবী মানুষে বেঁচে থাকা এই সাহসটা অনুকরণযোগ্য। সকলকে অনুপ্রেরণা দেয় তাঁদের দৃঢ়চেতা মানসিকতা। এমনটি দেখা গেলো ২০১৯-র আগস্টের ঘটনা। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার থেকে পড়ে ৫ দিন সমুদ্রে ভেসে থাকার ঘটনাটাও অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের উপকূলীয় বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার ১৪ বছরের মহম্মদ ইমরান হোসেন তা করে দেখিয়েছে।
নিজের লুঙ্গিতে বাতাস ভরে স্রেফ প্রাণ রক্ষার তাগিদে সমুদ্রে ভেসে বেরিয়েছে পাঁচ-পাঁচটা দিন। ভাসতে ভাসতে কোনোক্রমে ভারতীয় সীমানা আসা সেই ইমরান’কে উদ্ধার করে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৎস্যজীবীরা। ইমরান জানিয়েছিলো, মাছ ধরে ২৭ আগস্ট তাঁরা ১২ জন মৎসজীবী যখন ফিরছিলেন তখন ঘটে যায় দুর্ঘটনা। বলেশ্বর নদের মোহনায় দমকা ঝড়ের কবলে পড়ে তাঁদের ট্রলার।
ঝড়ের তোড়ে মুহূর্তের মধ্যে ইমরান ট্রলার থেকে ছিটকে পড়ে সাগরে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রস্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাঁকে। উত্তাল সমুদ্রে কোনও কিছু ছাড়া ভেসে থাকা অসম্ভব। তাই ইমরান বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের পরনের লুঙ্গি খুলে তাতে বাতাস ভরে ফুলিয়ে নেয়। তা সেটা ধরে সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় ৫ দিন। খাওয়া-দাওয়া তো দূর, পাঁচ দিনের মধ্যে ইমরানের মুখে পড়েনি এক ফোঁটা জল।
এই ঘটনাই ফের মনে করিয়ে দেয় সাংবাদিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প’-কে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার মরণপণ লড়াই ফুটে ওঠেছে ওই গল্পে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে ওই লেখা। ১৯৫৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলম্বিয়া নৌ যুদ্ধজাহাজ ‘ক্যালডাস’ ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে। জাহাজটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছিল। গন্তব্য ছিল কলম্বিয়ার কার্টাগেনা বন্দর। জাহাজটি ফিরছিল, কিন্তু ঝড়ে ৮ জন নাবিক সমুদ্রে নিখোঁজ হয়ে যান।
বেঁচে ফেরেন ২০ বছরের এক যুবক নাবিক। চারিদিকে যখন কোনও আশার আলো নেই, তখন স্রেফ জীবন তৃষ্ণায় ধাবিত হয়ে ওই নাবিক নিজেই বাঁচার পথ নিজেই তৈরি করছিলেন। খাদ্য-পানীয়ের তোয়াক্কা না করেই তিনি ফিরে এসেছেন পাড়ে। যখন সহ-নাবিকরা বাঁচার আশা ছেড়েছেন, তখন ওই তরুণ নাবিক লুই অ্যালজানদ্রো ভেলাসকো দেখিয়েছেন জীবনের লড়াই কী করে একজনকে বলশালী করে তোলে। 


দিশাহারা সমুদ্রে লড়াই করে ফেরা ওই নাবিক পরে ‘বীর’ বনে যান। লুই অ্যালজানদ্রো ভেলাসকো বলছেন, ‘‘আমি কখনো ভাবিনি, যে একজন মানুষ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা উপেক্ষা করে  দশদিন বোটে থাকলে বীর বনে যেতে পারে। আমার অন্য কোনও বিকল্প ছিল না। ...আমি বীরের মতো কিছু করিনি। আমার চেষ্টা ছিল শুধু নিজেকে বাঁচানোর। কিন্তু এই উদ্ধার পাওয়াই একটা রঙিন মোড়ক পেল। উপহার পেলাম বীরের আখ্যা। একটা মিঠাইয়ের মতো ভেতরে বিস্ময়। আমার উপায় রইল না, যেভাবে এই উদ্ধার পেলাম, বীরত্ব আর সব কিছু সেইভাবে মেনে নেওয়া ছাড়া।’’
তরুণ নাবিকের এই উপলব্ধিটি যেন সব শ্রমজীবী মানুষের অন্তরের কথা। এমন ঘটনা ঘটছে আমাদের দৈনন্দিনের বাস্তব জীবনে। চেনা পরিস্থিতিতে ঘটছে একের পর এক। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল খুদে প্রিন্সের ক্ষেত্রে। হারিয়ানার কুরুক্ষেত্রে প্রিন্সকুমার কাশ্যপকে হয়ত মনে থাকবে অনেকের। ২০০৬ সালে জুলাইয়ে পাঁচ বছরের প্রিন্স বন্ধুর সঙ্গে খেলতে খেলতে পড়ে গেছিল ৬০ ফুট গভীর পরিত্যক্ত নলকূপে।  
ছোট্ট ছেলেটির নলকূপে পড়ে যাওয়া আসমুদ্র হিমাচলের মানুষ একত্রিত হয়েছিলো। ধর্ম-বর্ণ  উপেক্ষা করে উৎকণ্ঠিত দেশবাসী তাঁর উদ্ধারকে আশু লক্ষ্য করেছিলেন। টানা দু’দিন সেখানে থাকার পর সেনা জওয়ানরা প্রিন্স’কে উদ্ধার করে। বালক প্রিন্স’কে উদ্ধারের সেই লড়াইটা দেশের লড়াইয়ে রূপ পেয়েছিল। প্রিন্সের সেই উদ্ধারের ঘটনা দেখতে টিভির সামনে রাত জেগেছেন প্রতিটি মানুষ। 
উদ্ধারের পর সেনাবাহিনীর উল্লাসের সঙ্গে দেশের আমজনতা বাধভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। এর পরবর্তীতে প্রিন্স বনে যায় ‘দেবশিশু’তে। রঙিন এই মোড়ক দিয়েছিল সেখানকার সমাজ। যেকোনও অনুষ্ঠান থেকে ধর্মীয় সভাই হতো না ‘প্রিন্স’ ছাড়া। প্রথম দিকটায় আশ্বাস, দেদার সাহায্য অনেকটাই পরিবর্তন করেছিল প্রিন্সের পারিবারিক জীবন। কিন্তু সময় যত গেছে, ততই কঠোর বাস্তব ভুলিয়ে দিয়েছে প্রিন্স’কে।
এখন প্রিন্সকে বাবা রামকৃষ্ণ কাশ্যপের সঙ্গে মাঠের চাষের কাজ করতে হচ্ছে। সেনাবাহিনীতে যাওয়া স্বপ্ন তাঁর। সেনাবাহিনীই তাঁকে ‘মৃত্যুকূপ’ থেকে উদ্ধার করেছিলো। দিয়েছিল নতুন জীবন। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা তাঁকে শিখিয়েছে জীবন যুদ্ধে ওই ‘বীর’ বনে যাওয়াটা ক্ষণিকের। কেউ শেষে কথা রাখে না। নিজের কঠিন শ্রমই দেখাতে পারে উত্তরণের পথ। 
নিজেকে বাঁচানোর লক্ষ্যেই লড়তে হয় মানুষকে। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে প্রায়শই বঙ্গোপসাগরে সাক্ষাৎ মৃত্যুর লড়াই করে ফিরতে দেখা গেছে মৎসজীবীদের। কখনও  ৩৬ ঘণ্টা কখনো ১২০ ঘণ্টা সমুদ্রে ভেসে থেকে তাঁরা বাঁচার লড়াই চালিয়ে গেছেন। জীবনভর অনিশ্চয়তার মাঝে শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকাটা লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। দেশকাল ভুলে ডুবতে বসা সাথি বাঁচাতে নিজের জীবনকে বাজি রাখেন আর এক শ্রমজীবী মানুষ।
এই তো ২০২৩-এর ২০ আগস্টের ঘটনা। ঝোড়ো বাতাসে উত্তাল সমুদ্রে ডুবে যায় বাংলাদেশের মেছো ট্রলার ‘স্বাধীন ফিশিং’। ওই ঘটনায় ১১ জন মৎসজীবী জলে ভাসতে ভাসতে ভারতীয় জলসীমায় চলে আসেন। বঙ্গোপসাগরের মাছের সন্ধানে যাওয়া ভারতীয় ট্রলার ‘মা-মালবিকা’র  মৎসজীবীরা দেখতে পান তাঁদের। নিজেদের জীবন বাজি রেখে বাঘের চর থেকে উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশের মৎস্যজীবীদের। গত পাঁচ বছর ধরে একইভাবে দুই দেশের মৎসজীবীরা একে অন্যকে রক্ষার কাজটা করে এসেছেন। কোনও পুরস্কার কিংবা বাহবা জন্য নয়, সহমর্মিতাই তাঁদের এই কাজ করিয়েছে।   

তবু কাউকে অবলম্বন করেই তো গড়ে ওঠে উদ্ধারের সেই অমানবিক শক্তি। ঠিক যেমনটি  উত্তর কাশীর ওয়াকিল হাসান’কে সামনে রেখে হার না মানার লড়াইয়ে নেমেছিলেন মুন্না কুরেশিরা। ঠিক এমনই রাজ্যের রানিগঞ্জের কুনুস্তরিয়ায় কয়লা খনি দুর্ঘটনায় ভরসার হাত বাড়িয়ে ছিলেন যশবন্ত সিং গিল। তিনি এখন বায়োপিকের ‘হিরো’। কিন্তু ১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর মহাবীর কোলিয়ারি খনিতে যখন ৬৫ জন শ্রমিক আটকে পড়েছিলেন, তখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাঁচিয়ে সেই সব মানুষকে।
পাশের পরিত্যক্ত খনি থেকে কোনোভাবে মহাবীর কোলিয়ারি’তে ঢুকে পড়া জলস্রোত প্রাণও কেড়েছিল ৬ জন শ্রমিকের। কিন্তু জলে আটকে থেকে জীবনের লড়াই চালিয়ে যান টানা ৩ দিন। পরে সাহসী মাইন ইঞ্জিনিয়ার যশবন্ত সিং গিল নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার করেন আটকে থাকা বাকি ৬৫ জন’কে। যশবন্ত সিং গিলের সঙ্গে নিজের সহকর্মীদের উদ্ধারে নেমেছিলেন সব খাদান কর্মীরা। অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে এক মূহুর্তে তাঁরা ভাবেননি। লক্ষ্য একটাই ‘মিশন রানিগঞ্জ’। বিশেষ ক্যাপসুল লিফট বানিয়ে শ্রমিকদের সেখান থেকে বার করে আনা কোনও মোড়কে ঢাকা যায় না।
 

Comments :0

Login to leave a comment