RATION SCAM ED

ইডি তদন্তের মাঝে চাল গম চুরি

রাজ্য

  ইডি’র তদন্ত চলাকালীনই খাদ্য দপ্তরের রেশন দুর্নীতিতে নতুন করে প্রায় ২৪ হাজার কুইন্টাল চাল-গমের হিসাব নেই। রাজ্যবাসীর কাছে রেশন পৌঁছানোর আগেই চুরি হয়ে গেছে রেশন সামগ্রী!
দুর্নীতির সঙ্গে সহবস্থানে খাদ্য দপ্তর এখন এতই বেপরোয়া যে, প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তারির পরেও পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ পর্যন্ত করা হয়নি। বিপুল এই দুর্নীতির হদিস উঠে এসেছে খাদ্য দপ্তরেরই নিজস্ব নজরদারিতে। বিপুল এই দুর্নীতির সন্ধান পেয়েও কোনো কার্যকরী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নেয়নি দপ্তর। 
খাদ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার দুই জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে ডিস্ট্রিবিউটারের গুদামে হানা দিয়ে বরাদ্দের গরমিলের হিসাব পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাশপাশি বীরভূমের রামপুরহাটের এক কো- অপারেটিভ সোসাইটির গুদামে আকস্মিক পরিদর্শন চালিয়ে মিলেছে বরাদ্দের সঙ্গে জোগানের বিপুল ঘাটতি। দপ্তরের এক আধিকারিকের কথায়,‘‘ রেশনে এক কুইন্টাল চালের দাম ৩৮০০ টাকা। সব মিলিয়ে শুধু চালের যে গরমিলের হিসাব পাওয়া গেছে তাতেই টাকার অঙ্কে ১০ কোটির বেশি।’’ চাল ও গমের পাশপাশি হদিস নেই আটা ও চিনিরও। চাল, গম আটার বিপুল চুরি মিলিয়ে প্রায় দুর্নীতির অঙ্ক ১৫ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।  সরকারি তরফে বরাদ্দ এই সামগ্রী ডিস্ট্রিবিউটারের হাত থেকে রেশন ডিলারদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা। বিপুল ঘাটতির ফলে শেষ পর্যন্ত প্রাপ্য রেশন সামগ্রী থেকে বঞ্চিত হবেন সাধারণ রেশন গ্রাহকরা।
রেশন দুর্নীতির তদন্তে গ্রেপ্তার হয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমান। আদালতে চার্জশিট দাখিল করে ইডি জানিয়েছেন শুধু ধান কেনাবেচাতেই দুর্নীতির অঙ্ক ৪৫০ কোটি। তারসঙ্গে রেশন চাল-আটা দুর্নীতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। 
বিপুল এই দুর্নীতি ঘটেছে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর আমলে। কিন্তু  ইডি’র তদন্তের আওতায় না থাকলেও খাদ্য দপ্তরের দুর্নীতি বহমান। সাম্প্রতিক সময়েও খাদ্য দপ্তরের তরফ থেকে রেশনের চাল, আটা ও চিনি সরবরাহকারী ডিস্ট্রিবিউটারদের কাছে নজরদারি চালাতে গিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির হদিস মিলছে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, দুর্নীতির আবহে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা খাদ্য দপ্তর এতকিছুর পরেও গোটা ঘটনাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার পরেও কোনো কার্যকরী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। 
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকরা কাকদ্বীপ এলাকার এক ডিস্ট্রিবিউটারের গোডাউনে তল্লাশি চালাতে গিয়ে রেশন সামগ্রীর ব্যাপক ঘাটতি উঠে আসে। প্রায় ১৫ হাজার কুইন্টালের ওপর চাল ছিল না। অথচ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এই চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল ডিস্ট্রিবিউটারের কাছে। বরাদ্দ চালের আর্থিক মূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। বরাদ্দ এই চালের হদিস না মেলায় ডিস্ট্রিবিউটারকে শুধুমাত্র শোকজ ও সাসপেনশন নোটিশ ধরিয়ে চুপ করে বসে আছে দপ্তর। বিপুল আর্থিক দুর্নীতির পরেও কোনো আর্থিক জরিমানা তো দূরের কথা। থানায় অভিযুক্ত ডিস্ট্রিবিউটারের নামে এফআইআর পর্যন্ত করা হয়নি। কাকদ্বীপে যে ডিস্ট্রিবিউটারের কাছ থেকে ১৫ হাজার কুইন্টালের বেশি চাল ও গমের গরমিল মিলেছে ও ডিস্ট্রিবিউটারের সঙ্গে কাকদ্বীপ এলাকার ৬৮টি রেশন দোকানে চাল, গম, আটা সরবরাহ হওয়ার কথা। কিন্তু গরমিলের তথ্য হাতে নিয়ে খাদ্য দপ্তর শুধুমাত্র শোকজ করে বসে আছে। 
দপ্তরের এক আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘ ডিস্ট্রিবিউটারকে শোকজ কিংবা সাসপেনশন কোনোভাবেই কার্যকরী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হতে পারে না। অভিযুক্তের কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ চাল ও গম পাওয়া না যাওয়ার জন্য আর্থিক জরিমানা করার কথা। একইসঙ্গে থানায় এফআইআর করা দরকার। তার কোনোটাই হয়নি। বরং চুরি আড়াল করতে কোথাও অতিরিক্ত বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও ডিস্ট্রিবিউটারের সঙ্গে রফা করা হয়েছে।’’ 
কাকদ্বীপের পাশপাশি গত জুলাই মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মগরাহাট ১ নং ব্লকের মগরাহাট লার্জ সাইজ কো অপারেটিভ মার্কেটিং সোসাইটির গুদামে হানা দিয়েও একইভাবে বিপুল পরিমাণ চাল ও গমের হিসাবের গরমিল নজরে আসে খাদ্য দপ্তরের। ৬ হাজার কুইন্টালের ওপর চাল গমের পাশপাশি জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনার আর্থিকভাবে সবথেকে অসহায় মানুষের জন্য বরাদ্দের প্রায় ৭ হাজার কেজির ওপর চিনি পাওয়া যায়নি। মগরাহাট ১ নং ব্লক এলাকার সমস্ত রেশন দোকানের জন্য সামগ্রী সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল অভিযুক্ত কো অপারেটিভটির। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, তৃণমূল কংগ্রেসের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা সমবায় প্রতিষ্ঠানটিকে এক্ষেত্রেও শোকজ ও সাসপেনশান করে দায় সেরেছে রাজ্যের খাদ্য দপ্তর।
দুর্নীতির সঙ্গে সহাবস্থানে অভ্যস্ত খাদ্য দপ্তর তৃণমূল ঘনিষ্ঠ কো অপারেটিভের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তো করেইনি। উপরন্তু নজরদারিতে উঠে আসা চাল, গম ও চিনির বিপুল ঘাটতির মোকাবিলা করার জন্য এফসিআইকে চিঠি দিয়ে অতিরিক্ত বরাদ্দের আবেদন করেছিল। গত ৬ জুলাই রাজ্যের খাদ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে এফসিআই’এর জেনারেল ম্যানেজারকে চিঠি দিয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসের জন্য জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা যোজনা(এনএফএসএ)র জন্য ৩০৯ টন চাল ও ১৭৯ টন গম চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। 
খাদ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রেশন কার্ডের হিসাবে চাল, গম, আটা, চিনির সরকারি বরাদ্দ প্রথমে পৌঁছে দেওয়া হয় ডিস্ট্রিবিউটারের কাছে। ডিস্ট্রিবিউটারের কাছ থেকে রেশন ডিলাররা তাদের প্রয়োজনীয় রেশন সামগ্রী সংগ্রহ করে নেয়। কিন্তু পরিদর্শনের পর তিন ডিস্ট্রিবিউটারের কাছ থেকে রেশন সামগ্রীর যে বিপুল গরমিল সামনে এল তার ফল কী হতে পারে? আধিকারিকদের বক্তব্য,‘‘ যা হয়েছে তা আসলে চুরিই। এর প্রথম প্রভাব পড়বে রেশন গ্রাহকদের ওপর। তাঁরা প্রাপ্য সামগ্রী কম পাবেন। অনেক গ্রাহকই জানেন না, তাঁদের কার্ড অনুযায়ী কতটা চাল গম থেকে চিনি প্রাপ্য।’’
মগরাহাটের মতোই বীরভূমে তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত রামপুরহাট লার্জ সাইজ কো অপারেটিভ মার্কেটিং সোসাইটির গুদামে পরিদর্শন চালিয়ে প্রায় ২১০০ কুইন্টাল চাল, ৪৬ কুইন্টাল আটার হদিস পাওয়া যায়নি। যার অর্থ  বিপুল পরিমাণ রেশন সামগ্রী চুরি হওয়ার পরও দপ্তর হাত গুটিয়ে বসে আছে।

Comments :0

Login to leave a comment