Rail jangalmahal

জঙ্গলমহলে রেলপথের দাবি এবং ‘বাসুবাবু’

জাতীয় বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

ভাস্কর দাশগুপ্ত


‘‘আমরা যারা গাঁয়ের মানুষ গাঁয়ে মা'য়ে সমান বুঝি/
দিব্যি করে বলছি মশয় গাঁয়ের ক্ষতি সইতে পারি।’’
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার করার পরও জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় রেলপথ নেই। অথচ উন্নত আমরা চাঁদে পাঠাচ্ছি চন্দ্রযান। জানতে চাইছি সূর্যের ইতিহাস। পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, মানবাজার সহ জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ অংশের মানুষ ট্রেন পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। ঝাড়গ্রাম-বান্দোয়ান রেলপথের প্রস্তাব আজ নয় দীর্ঘদিনের। এই রেলপথ নিয়ে একটাই মানুষ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কনভেনশন করে বেরিয়েছেন, মানুষকে সংগঠিত করেছেন, লোকসভায় আওয়াজ তুলেছেন। তিনি হলেন প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া। যতদিন সংসদে ছিলেন ঝাড়গ্রাম-বান্দোয়ান রেলপথের স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মানুষ বিশ্বাস করতেন। তাই সেদিন তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিল। তাঁর মৃত্যু হয়তো একটা স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। গত কয়েক বছরে কেউ শোনেনি বান্দোয়ান-ঝাড়গ্রাম রেলপথের কথা। এই অঞ্চলের মানুষের দাবি তোলার আজ আর কেউ নেই। জঙ্গলমহলের এই অঞ্চলে কাশফুল ফোটে। কিন্তু সেই কাশফুলের ফাঁক দিয়ে অপু দুর্গাদের ছুটে গিয়ে ট্রেন দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাই এই অঞ্চলের অপু দুর্গারা কবে রেলপথ দেখবে বা আদৌ রেলপথ দেখবে কিনা তা কেউ জানে না।
কনকনে শীতের মধ্যে রোদ্দুরে বসে আমেজ নিয়ে কথা বলছিলেন মানবাজার-২ ব্লকের আঁকরো গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ভক্তরঞ্জন মাহাতো। কথায় কথায় বললেন,‘‘যতদিন বাসুদেব আচারিয়া ছিলেন তখন এই রেলপথ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। এই রেল পথের দাবি উঠেছে। ক্ষমতার পরিবর্তনের পর এই অঞ্চলের গরিব মানুষগুলোর আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে জঙ্গলমহলে রেলপথের কথা আর কেউ কোনদিন তোলেনি। বাসুদেব আচারিয়া রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বলেই এখানকার মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন। গত কয়েক বছরে কি লোকসভার ভেতরে, কি লোকসভার বাইরে এই অঞ্চলের গরিব খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলার আর কেউ নেই। কয়েক বছর আগেও আঁকরো হাই স্কুলে বান্দোয়ান ঝাড়গ্রাম রেলপথের দাবিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কনভেনশন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাসুদেব আচারিয়া। তার সাফ কথা -"বাসু বাবু নেই, স্বপ্ন দেখা নেই।" বান্দোয়ানের বাসিন্দা শক্তিপদ দাসের দাবি ঝাড়গ্রাম বান্দোয়ান রেলপথ হলে এই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থাটা বদলে যেত। রেলপথ হলে জীবন জীবিকার পরিবর্তন হতো এই অঞ্চলের মানুষের। নিজে উপস্থিত থেকে বাসুদেব আচারিয়া এক সময় রেলের কর্মচারীদের এনে কুইলাপালে প্রয়োজনীয় সার্ভে করিয়েছিলেন। তার আক্ষেপ এখন আর এই রেলপথের কথা কেউ ভাবে না। বান্দোয়ান কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সুব্রত মাহাতোর বক্তব্য প্রস্তাবিত এই রেলপথটি হলে যাতায়াতের একটা নতুন দিক খুলে যেত। এখন কষ্ট করে পুরুলিয়া শহরে যেতে হয়। কলকাতা যাওয়া আরো কষ্টের। তারও দাবি অবিলম্বে নতুন করে ভাবা হোক প্রস্তাবিত এই রেল পথ নিয়ে।


বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বামপন্থী সাংসদরা বহুবার এই রেল পথ চালুর দাবিতে লোকসভার ভেতরে এবং বাইরে সরব হয়েছিলেন। ১৯৯৬-৯৭ এবং ২০০৫ সালে রেলের সার্ভে রিপোর্টে এই রেলপথকে অলাভজনক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এই রেল পথ নিয়ে যিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তৎকালীন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া ২০০৮ সালের রেল বাজেটের পর ২০০৮ সালের রেল বাজেটেও এই রেলপথ কে অলাভজনক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। তিনি লোকসভায় দাবি তুলেছিলেন যে সরকারের সিদ্ধান্ত আছে যেসব এলাকা আদিবাসী প্রধান সেসব এলাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে অলাভজনক হলেও রেলপথ চালু করা হবে। এই রেলপথ চালু হলে ঝাড়গ্রাম থেকে বান্দোয়ান দীর্ঘ ১৩৫ কিলোমিটার পথের দুপাশের মানুষের জীবনে স্থায়ী ছাপ ফেলতই। বামপন্থী সাংসদদের দাবির কাছে কার্যত নতি স্বীকার করে ২০০৮ সালে রেল বাজেটের পর রেলমন্ত্রক ফের প্রকল্পটি সার্ভে করতে রাজি হয়েছিল। বাসুদেব আচারিয়ার কাছ থেকেই জানা- ২০০৮ সালে সর্বশেষ সার্ভেতে ঝাড়গ্রাম-বান্দোয়ান রেলপথকে ১০.৫% রেট অফ রিটার্ন অর্থাৎ সাড়ে ১০% লাভজনক দেখানো হয়েছিল। রেল মন্ত্রক এই রেলপথটিকে ডাইভারটেড ট্রাফিক হিসেবে দেখিয়েছিল। সেই রিপোর্টটিকে ‘আপগ্রেটেড রিপোর্ট’ হিসেবে প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুমতির জন্য প্ল্যানিং কমিশনের কাছেও পাঠানো হয়েছিল। এই রেলপথের জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫১৭ কোটি টাকা। কিন্তু সেখান থেকে আর অনুমোদন আসেনি। 
কিন্তু বাসুদেব আচারিয়া যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এই রেল পথের দাবিতে সরব হয়েছেন। প্রয়োজনে রেল মন্ত্রকে চিঠি লিখেছেন। একান্ত আলাপচারিতায় মাঝে মাঝে বলতেন,‘‘কেউ এই অঞ্চলের মানুষের কথা ভেবে এই রেলপথের দাবি আর তুলছেন না। যদি তুলতেন এই অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবনযাত্রা আমূল বদলে যেত।’’ তার আক্ষেপ ছিল এই অঞ্চলের রেল পথ নিয়ে। সেই আক্ষেপ নিয়েই মানুষটি চলে গেলেন। তার চলে যাবার পর পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, মানবাজার ২, মানবাজার , বরাবাজার প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষ বলছেন- একটা সম্ভাবনার হয়তো চিরকালীন ইতি ঘটল।
এই অঞ্চলের মানুষের কথা ভাবেন না বলেই ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার সাংসদেরা কখনোই লোকসভায় জঙ্গলমহলের এই অঞ্চলের মানুষের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রস্তাবিত সেই রেলপথের আর কোনো দাবি তোলেন না। প্রস্তাবিত সেদিনের সেই ঝাড়গ্রাম বান্দোয়ান রেলপথের যাত্রাপথ ছিল ঝাড়গ্রাম থেকে বিনপুর, রাইপুর, বারিকুল, রানিবাঁধ, অম্বিকানগর, মুকুটমণিপুর হয়ে বান্দোয়ানকে ছুঁয়ে মানবাজার ২, মানবাজার ১, চাকোলতোড়, টামনা হয়ে পুরুলিয়া।
তাদের কথা যে মানুষটা ভাবতেন সেই বাসুদেব আচারিয়ার স্মরণ সভায় রবিবার বান্দোয়ান, বোরো, বরাবাজার থেকে বাবলু মাহাতো, শুকদেব সিং, শ্রীমন্ত সিং ,লক্ষী মানকিরা আসবেন। তাদের কথা ভেবেই তো বামপন্থী সাংসদেরা সরব হয়েছিলেন বান্দোয়ান ঝাড়গ্রাম রেলপথ নিয়ে। কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেলেও এই অঞ্চলের জমিতে পাতা হয়নি রেলের ট্রাক। বঞ্চনার ইতিহাস গায়ে মেখে তাই বাবলু, শ্রীমন্ত, শুকদেব, লক্ষ্মীরা হয়তো আওয়াজ তুলবেন-
‘‘ই মাটি সবার, ই আকাশ সবার
সবার লাইগে সব কিছু সমান না হল্যে
কাল্লায় কাল্লায় শোধ লিবো আইজ্ঞা
ই কনহ অন্যায় লয়- কনহ অন্যায় লয়।’’
              মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায়
 

Comments :0

Login to leave a comment